বাতায়ন/মাসিক/রম্যরচনা/৩য় বর্ষ/১৯তম সংখ্যা/১৩ই ভাদ্র, ১৪৩২
রম্যরচনা
উত্তম
ভট্টাচার্য
ভগবান
ডট কম
[১ম পর্ব]
"অনেকক্ষণ ধরে মা অনুভব করছিলেন তাঁর বসবার সিটটা কেমন যেন লাগছে। কেমন যেন চটচটে ভিজা ভিজা ঠেকছে। পেটটা খারাপ হয়নি তো তাঁর? কিছু বদকাম করে বসেননি তো এই ট্রেনের কামরায়!"
বছর দুয়েক হলো ব্যাংকের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন সুখরঞ্জন চক্রবর্তী। বিধবা মা, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঝাড়া হাত-পায়ের সংসারে ওঁরা মোট চারজন। এরমধ্যেই দেশের প্রায় সব তীর্থক্ষেত্র চষে ফেলেছেন তিনি। এমনকি রাজ্যের ছোটবড় প্রাচীন মন্দির এবং উল্লেখযোগ্য স্থানগুলোও। অবসর গ্রহণের পরে সেই পুরনো রোগটা যেন আরও তিনগুণ বেড়ে গেছে তাঁর। মাকে নিয়ে আজ পুরী, কাল নবদ্বীপ তো পরশু কামাখ্যা মন্দির চষে বেড়াচ্ছেন আজকাল।
এবারের প্ল্যানটা
অবশ্য মায়ের ঠিক করা। মায়ের ইচ্ছাতেই মহাষ্টমীর ভোররাতেই সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে
হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছেন ওঁরা। কামারপুকুর
জয়রামবাটি গিয়ে শ্রীশ্রী মা এবং ঠাকুরের দর্শন সেরে অন্নভোগ গ্রহন করবেন
সেখানেই। তবে, তা পেতে পেতে তো সেই
একটা কিংবা দু'টাও বেজে যাবার সম্ভাবনা।
সাড়ে বারোটার আগে তো কিছুতেই সম্ভব হবে না। সাতসকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে কিছু
মুখে না দিলে কি চলে?
সুখরঞ্জনবাবুর মা সাত্ত্বিক মানুষ। ব্রাহ্মণকূলের বিধবা রমণী! তাঁর হাজারটা
প্যাকনা। দিনক্ষণ পঞ্জিকা ছাড়া এক পাও নড়তে পারেন না। এবেলা এটা করা চলে না, ওবেলা এটা করা বারণ, রবিবারে গুরুদেবের জন্ম, মঙ্গলবারটা মা মঙ্গলচন্ডীর জন্য! বিস্যুদবার তো লক্ষ্মীবার!
লক্ষ্মীবারের হাঁড়ি মাজাঘষার নিয়ম। মাছ-মাংসের
প্রশ্নই ওঠে না। শনিবারটা বড়ঠাকুরের,
কোনোটা
আবার লোকনাথের, কোনোটা বা তাঁর গোপালঠাকুরের!
এই করে সপ্তাহের প্রায় সবকটা দিনই নিরামিষ খাবারেই কেটে যায় তাঁর জীবন।
সুখরঞ্জনবাবু ততটা না হলেও
ইদানিং রিটায়ার্টমেন্টের
পর, বয়সজনিত কারণে মাছ-মাংস অতটা
সহ্য করতে পারেন না। মায়ের মত লাউ দিয়ে ডালেতেই তিনি বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।
একমাত্র স্ত্রী শান্তাদেবী আর কলেজের পড়া ছেলে তাতাইকে
নিয়েই তাদের যত বাড়তি বিড়াম্বনা! রাস্তায় বেরুলে কেনা খাবার ছাড়া এদের চলে
না। এতে বিধবা মায়ের তো বটেই এমনকি সুখরঞ্জনবাবুরও একটু-আধটু অসুবিধা
হয় বইকি। তবে, আজকের দিনটা সবার
কাছেই সম্পূর্ণ রূপেই একটু আলাদা। মহাষ্টমীর পুণ্য তিথি বলে কথা। আজ স্নান
ধ্যান সেরে শুদ্ধ বস্ত্রে পবিত্র হৃদয়ে মহাষ্টমীর পূজা অঞ্জলি দিয়ে নিরামিষাশী
আহার গ্রহণ করাটাই একমাত্র রীতি চালু আছে। ব্রাহ্মণ ঘরের
সন্তান হয়ে, বিশেষ করে ব্রাহ্মণের
বিধবা রমণী হয়ে এসব নিয়মকানুন রীতিনীতি বাছবিচার না করলে কি চলে? লোকে কী বলবে? ভগবানের কাছেই বা কী
কৈফিয়ত দেবেন 'উপরে' গিয়ে। তাই, স্ত্রীকেই বাড়তি
দায়িত্ব পালন করতে হয় আগের দিন রাতে। শাশুড়ি-মা আর স্বামীর
জন্য বাড়ি থেকেই নানান খাবার তৈরি করে টিফিন ক্যারিয়ারে এ পুরে নিতে হয় স্ত্রীকেই।
ছেলেটা বড় হয়েছে। এখন আর
বন্ধুবান্ধবদের সাথে দলবেঁধে হই-হুল্লোড় করতে করতে কোলকাতায় গিয়ে পুজো
দেখা ছেড়ে বাপমায়ের সাথে খুব একটা বেরুতে চায় না ছেলেটা। তাই, তার জন্যও আলাদা রান্না করে রেখে যেতে হবে ফ্রিজে। তবুও, সবদিক সামলিয়ে - সেই ভোররাতে উঠেই তাড়াহুড়ো করে স্নান
ধ্যান সেরে নতুন জামা কাপড় পরে একটা মস্ত টিফিনের ব্যাগ মা'র হাতে ধরিয়ে দিয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে কামারপুকুরের
উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়েছিলেন ওঁরা।
ট্রেনে অনেকটা পথ, অনেকটা গল্প, অনেক অনেক কথা- সুখ
দুঃখ হাসি ঠাট্টা ভালবাসা পেরিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মা অনুভব করছিলেন তাঁর বসবার সিটটা কেমন
যেন লাগছে। কেমন যেন চটচটে ভিজা ভিজা ঠেকছে। পেটটা খারাপ হয়নি তো তাঁর? কিছু বদকাম করে বসেননি তো এই ট্রেনের কামরায়! কিন্তু, তাই বা কী করে সম্ভব?
অবশ্য
অত সকালে পেটটা পরিষ্কারই বা হয় কার?
তাই
বলে... কী সাংঘাতিক! কী লজ্জার, কী লজ্জার! তবে এবার
কী হবে তাঁর! ছেলে-বউমার কথা না হয় ছেড়েই দাও; কিন্তু, লোকাল ট্রেনের এতগুলো
লোকজনের মাঝে? তারাই বা কে কী বলবে?
কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না মা।
এবার তাঁর কী হবে? আর এই নোংরা ময়লা
অশুচি জামাকাপড় পরে ঠাকুরের মন্দিরেই বা ঢুকবেন কোন সাহসে, কোন আক্কেলে! আজ মহাষ্টমীর পুজা বলে কথা। চিন্তা করতে
গিয়েই কান্না পেয়ে যাচ্ছিল মা'র। ভয়ে আর এক চুলও
এদিক-ওদিক নড়তে পারছিলেন না তিনি। কেবলই ঠাকুরের নাম জপ করছিলেন মনে মনে।
ক্রমশ
খুব ভালো লাগছে।
ReplyDeleteবেশ লাগল।
ReplyDelete