বাতায়ন/শারদ/প্রবন্ধ/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | প্রবন্ধ
ডাঃ দেবাশীষ
কুন্ডু
বাগনান
চন্দ্রপুরের বিশ্বাসবাড়ির দুর্গাপূজা
"এই দামোদর তীরবর্তী এলাকা ছিল ঘন জঙ্গল পরিবেষ্টিত, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মুক্ত চারণ ভূমি। বাগনান শব্দের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সেই সময়ের ত্রাস বা বিভীষিকা, বাগ অর্থাৎ বাঘের নান বা বিচরণ ক্ষেত্র।"
নির্বাসিত সম্রাট বাহাদুর শাহ
জাফর তখন খিদিরপুরে, তাঁর সঙ্গে এসেছিল
কিছু নির্বাচিত লোকলশকর, দাস-দাসী, পরিচারক, উলেমা এবং
রন্ধনশিল্পী। কলকাতার এই অঞ্চলটার আর্থ সামাজিক পরিবেশ খুব দ্রুত বদলে যেতে থাকে, বনেদি হিন্দু পরিবারগুলি পাততাড়ি গোটাতে থাকে এই অঞ্চল থেকে, ব্রিটিশ ভারতের বিশিষ্ট বাঙালি উদ্যোগপতি আশুতোষ দত্ত তাঁর
পরিবার নিয়ে চলে আসেন হাওড়া জেলার বাগনানের চন্দ্রপুর নামের একটি লোকালয়ে এখানে
ভূসম্পত্তি ক্রয় করে একটি বিশাল সুরম্য আবাস-গৃহ নির্মাণ করেন ও বসবাস করতে
থাকেন, তিনি পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসরণ
করে দেবী লক্ষ্মীর পূজা সাড়ম্বরে করতেন।
এখন বাগনান একটি কলকাতাঘেঁষা
শহরতলি কিন্তু সেইসময় এই দামোদর তীরবর্তী এলাকা ছিল ঘন জঙ্গল পরিবেষ্টিত, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মুক্ত চারণ ভূমি। বাগনান শব্দের
মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সেই সময়ের ত্রাস বা বিভীষিকা, বাগ অর্থাৎ বাঘের নান বা বিচরণ ক্ষেত্র।
উদ্যোগপতি আশুতোষ দত্তের
ব্যবসায়িক মুন্সিয়ানার কথা অজানা থাকে না ব্রিটিশ সরকারের কাছে, তার প্রতি ব্রিটিশদের ছিল অগাধ আস্থা, যে কারণে “বিশ্বাস” উপাধি দিয়ে তাঁকে সন্মানিত করে
ব্রিটিশরা। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ছিলেন দাশরথী বিশ্বাস।
একদিন কর্মসূত্রে কলকাতা থেকে
ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায় দাশরথীর, দামোদরের কাছে জঙ্গলে
হিংস্র বাঘের মুখোমুখি হন, সঙ্গের লোকেরা তাঁকে ফেলে
পালিয়ে যায়, সেদিন কুলদেবী মা লক্ষ্মীকে
স্মরণ করে চরম বিপদ থেকে রক্ষা পান। সেদিন ভোর রাতে দেবী দুর্গাকে স্বপ্নে দেখেন, সময়টা ছিল শরৎ কাল,
দিগন্তে
সাদা মেঘের পালকি, ভোরের শিউলি আর
কাশফুলের দল আগমনির সুরে দেবীকে ভূলোকে বোধন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতরা দেবীর
স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে বলেন, দশমহাবিদ্যার এক রূপ
দেবী কমলা বা লক্ষ্মী যিনি প্রসন্না, কিন্তু মূল আদি শক্তি
জগজ্জননী মহামায়া দেবী দুর্গা, তাঁর পূজার আয়োজন
করলে সার্বিক মঙ্গল হবে এবং দেবীর কৃপায় যাবতীয় বাধাবিপত্তি নাশ হবে। সেই শুরু, শুরুর সঠিক সাল তারিখ নিয়ে পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের
সদস্যদের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকলেও, প্রায় ১৫০ বছরের ওপর
বৈষ্ণব মতে দেবীর আবাহন করে চলে আসছেন বিশ্বাস পরিবার। বৈষ্ণব মতে পূজা কারণ
পরিবারের কুলদেবী মাতা লক্ষ্মী। রাধাস্টমীতে আজও যথাবিহিত শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী
পারিবারিক দীঘি থেকে মৃত্তিকা উত্তোলন করেন পুরোহিত, এর পর বাঁশ ও খড়ের কাঠামোর ওপর দেবী মূর্তি নির্মাণ কাজের সূচনা হয় পারিবারিক ঠাকুর দালানে।
এই পূজার বিশেষ বৈশিষ্ট, চিরাচরিত ঐতিহ্য ও সনাতনী প্রথার বিপরীতে সন্ধিপূজার
মহাসন্ধিক্ষণে দেবীকে রক্তকরবী অথবা রক্তজবার পরিবর্তে রঙ্গন ফুলের মালা পরানো হয়।
পূজার আয়োজন করতে এবং
আনুষঙ্গিক উপচারে আজও সেই পুরাতনী ঐতিহ্যের ছোঁয়া। বিসর্জনের পর ও প্রতিমা
নিরঞ্জনের পূর্বে পরিবারের সদস্যরা শঙ্খ বাজানো, দীপ প্রজ্বলন প্রভৃতির আয়োজন করেন,
যাতে
থাকে সম্প্রীতির বন্ধন।
সমাপ্ত

.jpeg)
No comments:
Post a Comment