বাতায়ন/নৃপেন
চক্রবর্তী সংখ্যা/ভ্রমণ/৩য় বর্ষ/২৮ সংখ্যা/১৪ই কার্ত্তিক,
১৪৩২
নৃপেন চক্রবর্তী
সংখ্যা | ভ্রমণ
অঞ্জনা মজুমদার
রাতমোহনার
মায়ায়
"সুবর্ণরেখা নদীর জলের স্রোত এখন তীব্র। মোহনার আগেই একজায়গায় জল একটু উঁচু নীচু আছে সেখানে জলের ঘূর্ণি সুন্দর দৃশ্য তৈরি করেছে।"
ঘাটশিলা মানেই আমাদের
বিভূতিভূষণের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে চাঁদের পাহাড়ের কথা। চাঁদের পাহাড় সিনেমার আগে
থেকেই চাঁদের পাহাড়ের রোমাঞ্চ আমাদের বয়সের বাঙালি যারা পড়ার বইয়ের নীচে গল্পের বই
রেখে পড়ায় ফাঁকি দিয়েছেন তাদের সবার জানা। বহু দেশ বিদেশে ঘোরা হলেও ঘরের কাছেই
ঘাটশিলা যাওয়া হয়নি। আর ফেসবুকের কল্যাণে সবারই ঘোরা হলেও আমাদের যাওয়া হয়নি। তাই
সুযোগ পেয়েই চললাম ঘাটশিলা হাওড়া রাঁচি দুপুরের ট্রেনে।
আমাদের উবেরের আসার দেরি আর
কলকাতার সিগন্যাল সিস্টেমের দৌলতে ট্রেন তিন মিনিট লেট না করলে এবারও যাওয়া হতো
না।
যাহোক আমাদের উবেরের চালক
রঘুবীর দক্ষ হাতে প্রচুর গাড়িকে ওভারটেক করলেন আর আমরা দৌড়ে দৌড়ে ট্রেনে উঠলাম।
ট্রেনের এ সি আরামদায়ক ছিল আর ট্রেন মাত্র চল্লিশ মিনিট লেটে যখন ঘাটশিলা পৌঁছাল
তখন সেখানে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।
মিনিট দশেক পরে বৃষ্টি কমতে
আমাদের আগে থেকে ফোন করা লজে যখন পৌঁছাতে পারলাম তখন মেঘের আঁধারে ঘরে জিনিসপত্র
রেখেই এক ড্রাইভারের কথায় গাড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম।
প্রথম সে নিয়ে গেল রাতমোহনায়।
পাঁচটি বৃষ্টির জলে পুষ্ট
জলধারা সুবর্ণরেখা নদীতে পড়ছে এটাই রাতমোহনা। ওটাই আমার কাছে ঘাটশিলার সুন্দরতম
স্থান বলে মনে হয়েছে।
সুবর্ণরেখা নদীর জলের স্রোত
এখন তীব্র। মোহনার আগেই একজায়গায় জল একটু উঁচু নীচু আছে সেখানে জলের ঘূর্ণি সুন্দর
দৃশ্য তৈরি করেছে। বর্ষার ভেজা না হলে ওখানেই বেশ কিছুটা সময় অলস মনে কাটিয়ে দেওয়া
যায়।
তারপর ঘাটশিলার মাতা রঙ্কিণী
মন্দির দেখলাম।
পরের গন্তব্য শহরের রামকৃষ্ণ
আশ্রম। সেখানে তখন আরতির সময়। একদিকে পুরুষ ভক্ত অন্যদিকে মহিলা ভক্তের বসার
জায়গা। অচেনা মহিলাগণ আমাকে সমাদরে তাদের মধ্যে বসার জায়গা করে দিলেন। তারপর বই
নিয়ে কোন প্রার্থনা সংগীত হচ্ছে তা বই খুলে দেখিয়ে দিলেন। তিনটি প্রার্থনা সংগীত শেষে আবারও আর একটা শুরু হলে
আমরা উঠে পড়লাম।
হোটেলে ফিরে একদম বাঙালি মতে
মাছের ঝোল ভাত খেয়ে ঘুম।
দ্বিতীয় দিন হোটেলেই
ব্রেকফাস্ট সেরে প্রথমে গেলাম গালুডি রঙ্কিণী মাতা মন্দির। সেখানে একজন সাধু আছেন
একশো নয় বছর বয়স। শতাধিক বয়সের কোনও মানুষ আমি কখনও দেখিনি। তিনি রীতিমতো হাঁটাচলা
করছেন। আমি দেখা করতে চাই শুনে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন।
মানুষ হইয়া জন্ম নিলাম
কারোর জন্য কিছু করলাম না।
অনেক দিন পৃথিবীতে রইলাম
আর রইতে ইচ্ছা হয় না।
এটা উনি সুর করে বলেছেন। কথার
অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে, নম্র চিত্তে বিদায়
নিলাম।
তারপর গালুডি লেক এর পাশ থেকে
লেকের টাটকা মাছ কিনে দুয়ারসিনি পৌছলাম।
সেখানে কেনা মাছভাজা, ডাল, আলুভাজা দিয়ে মোটা
চালের ভাত দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে নিলাম।
এবার গন্তব্য ঘাটশিলার
ফুলডুংরি পাহাড়ের মাথায়, যেখানে প্রখ্যাত লেখক
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বসে তার বিখ্যাত চাঁদের পাহাড় লিখেছেন। আরণ্যকের
সৃষ্টিও এখানেই। সেই স্থান দর্শন করে ধন্য
হলাম। এখান থেকে চারপাশের দৃশ্য দেখার মতো।
তারপর গেলাম ধারাগিরি
জলপ্রপাতের কাছে। সেই জলপ্রপাতের পথ উঁচু নীচু। সেখানে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা
পথপ্রদর্শক এর কাজ করে। দরাদরি করে পঞ্চাশ টাকায় গাইড ঠিক হল। নাম শীলা, স্কুলে পড়ে। আরও কয়েকটি ছেলে মেয়ে পিছনে পিছনে এল কিছু
পাবার আশায়। এটা একটু খারাপ লাগলো, দরিদ্র মানুষের জন্য।
এত বাচ্চা ছেলেমেয়েকে অবসরে রোজগারের পথ বেছে নিতে হয়? এই ভারতবর্ষ।
ধারাগিরির পথের শেষে
জলপ্রপাতের দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়।
পথে বুরুডি লেক। পাহাড় আর
জলের মিলনে অপরূপ। এখানে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সেদিন বন্ধ ছিল।
পৌছলাম গৌরীকুঞ্জে। স্ত্রী
গৌরীদেবীর নামে এই বাড়িতে বিভূতিভূষণের জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন। এখানে
স্থানীয় কয়েকজন মানুষের চেষ্টায় বিভূতিভূষণের কিছু স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ করা রয়েছে।
সেই সংগ্রহশালায় রয়েছে লেখক এর ব্যবহৃত পোশাক, হাতের লেখা, বেশ কিছু ছবি। এ সকল
স্মৃতিচিহ্ন শ্রদ্ধায় দর্শনের সৌভাগ্য হল।
উল্লেখযোগ্য হল এখানে একটা
বেসরকারি স্কুল চলে। নাম তারাদাস মঞ্চ অপুর পাঠশালা।
একটা কথা। বর্ষা ছাড়া
ঘাটশিলার যে রূপ দেখেছি তা দেখা হত না।
এবার ফেরার পালা। ট্রেন
যথারীতি বিলম্বে এল। সাঁতরাগাছিতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছাড়ছেনা দেখে নেমেই পড়লাম
আমরা। সেখানে একটা ক্যাব ধরে রাত এগারোটা বাড়ি ফিরলাম। মনে রয়ে গেল ঘাটশিলার
স্মৃতি।
সমাপ্ত






No comments:
Post a Comment