ইউক্রেন
পূর্বানুবৃত্তি ছোটবেলা থেকেই ভূগোল তিতিরের প্রিয়। অন্যান্য বিষয়ে খারাপ না হলেও ভূগোলের প্রতি অন্য রকম এক টান। ম্যাপ রিডিং-এর সময় মনে মনে নানা দেশে ঘুরে বেড়ানো। ‘সোভিয়েত দেশ’ পত্রিকা ও পত্রিকার ক্যালেন্ডারের দৌলতে দেশটাকে বিশেষ ভাবে ভালবেসে ফেলা। বাবার বন্ধুর ছেলে উৎসবদাকে ভালবেসে ফেলে তিতির। তারপর…
উৎসবদা ইউক্রেনে ডাক্তারী পড়ে। তিতির জানে ইউক্রেনে ডাক্তারী পড়া নিয়ে ওর মা খুব আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু ছেলের জেদের কাছে উৎসবদার মা হার মেনেছিলেন। উৎসবদার ছোটবেলায় ওর বাবা মারা যায়। তাই উৎসবদা চাইত বড় হয়ে ডাক্তার হবে এবং সবার সেবা করবে। বিশেষত ওর বাবার বয়সী লোকেদের বিনা চিকিৎসায় সারিয়ে তুলবে যাতে ওর মতো কাউকে অকালে বাবাকে হারাতে না হয়।
তিতিরের বাবা সব সময় উৎসবদাদের সুপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করত। বাবাও তাই উৎসবদাকে বারণ করেছিল ইউক্রেনে ডাক্তারী পড়তে যেতে। কিন্তু উৎসবদা বলত, আমাদের দেশে গভর্নমেন্ট কলেজগুলোতে ডাক্তারীতে চান্স পাওয়া বেশ শক্ত। আর প্রাইভেট কলেজে পড়তে প্রচুর টাকা লাগে। তাই আমি ঠিক করেছি ইউক্রেনেই ডাক্তারী পড়তে যাব। আমরা কয়েকজন বন্ধুরা মিলে যাব সেখানে। কয়েক বছরের তো ব্যাপার, দেখতে দেখতে কেটে যাবে কাকু।
উৎসবদা ইউক্রেন যাওয়ার খবরে আর কারো না হোক তিতির খুব আনন্দ পেয়েছিল। তিতির নিজে যেতে না পারুক কেউ তো যাবে ঐ দেশটাতে, এতেই তিতির খুশি। তবে দুঃখের বিষয় সোভিয়েত দেশটা তো এখন আর ছোটবেলায় ম্যাগাজিনে দেখার মতো নেই। ওরা এখন সবাই স্বাধীন হয়ে আলাদা দেশে পরিণত হয়েছে। তাই ইউক্রেন এখন আর রাশিয়ার মধ্যে নেই। ইউক্রেন এখন স্বতন্ত্র একটি দেশ। বর্তমানে ইউরোপের মানসিকতায় ঋদ্ধ ইউক্রেন। নিজেকে অনেক উন্নত জায়গায় নিয়ে গেছে দেশটি।
উৎসবদার থেকে তিতির জেনেছে ওখানে মেডিকেল এডুকেশন অনেক উন্নত। পাশ করলেই চাকরির সুযোগ করে দেয় ওখানকার সরকার। তাই উৎসবদা ডাক্তারী পাশ করে চাকরি পেলেই মা-কে নিয়ে গিয়ে একেবারে ইউক্রেনবাসী হবে। স্বপ্ন সফল করতে কারো কোনো কথা না শুনে উৎসবদা ইউক্রেনে ডাক্তারী পড়তে চলে গিয়েছিল। উৎসবদার কথা মনে পড়লে তিতিরের খুব ভাল লাগলেও, ছলছল চোখে ও উক্রেনের ম্যাপের দিক তাকিয়ে থাকে।
থার্ড ইয়ারে পরীক্ষা দিয়ে অল্প দিনের জন্য উৎসবদা দেশে এসেছিল । সে-সময় শ্রুতিদের বাড়িতে এসে সবার সঙ্গে ইউক্রেনের খুব গল্প করেছিল। বলেছিল, তার কোর্স আর বেশি দিনের নয়। এরপরে যখন আসবে তখন চাকরি নিয়ে এবং ওর মাকেও নিয়ে যাবে। তিতিরকে সবার আড়ালে বলেছিল “মা-কে নিয়ে যাবার সময় তিতিরকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে।”
তিতিরের সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায় উৎসবদার এ কথায়। উৎসবদা সেদিন সবার চোখ এড়িয়ে তিতিরকে খুব আদর করেছিল। তিতির বলেছিল, “তুমি আমার ভালবাসার ইউক্রেন, আমার ছোটবেলার সোভিয়েত দেশ। তোমার অপেক্ষায় থাকব উৎসবদা।”
সেবারে তিতিরদের বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে বাবা ও ছোট্কার সঙ্গে রাশিয়ার রাজনীতি নিয়ে উৎসবদাকে অনেক কথা বলতে শুনেছিল তিতির।
উৎসবদা বলছিল, “এখন ইউক্রেন খুব উন্নত একটি দেশ ঠিকই। তবে রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে কতদিন যে নিজেকে ধরে রাখবে ইউক্রেন সেটাই বোঝা মুশকিল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের শ্যেন-দৃষ্টি পড়েছে ইউক্রেনের ওপর। কী জানি ভবিষ্যতে কখন কী হয়! কিয়েভ শহরেই তো ওর মেডিকেল কলেজটা। আর কিয়েভ-এর ওপরই রাশিয়ার যত লোভ। এটাই যা চিন্তার। আশা করছি তাড়াতাড়ি সব ঠিক হয়ে যাবে। যাইহোক কাকু তোমরা চিন্তা কোরো না। ভাল থেকো আর আমার মা-কে দেখে রেখো।”
বাবা ও ছোটকাকে বলে যাওয়া উৎসবদার শেষের কথাগুলো তিতিরের খুব মনে পড়ে। কারণ উৎসবদা ইউক্রেনে চলে যাবার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওখানে যুদ্ধ বেধে যায়। রাশিয়ার প্রসিডেন্ট ইউক্রেনের কিয়েভ শহর দখল করার জন্য প্রচন্ড শক্তি দিয়ে যুদ্ধ শুরু করে দেয়। ফলে হাজার হাজার লোক মারা যায়। কলেজ ছেড়ে, শহর ছেড়ে সব ছেলেমেয়েরা পালাতে থাকে। ওখানে বিদেশ থেকে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করে। ওরা নিজের দেশের কাছে সাহায্য চায়। তিতির এ-সব কিছু জানতে পারে টিভি থেকে, খবরের কাগজ থেকে। ও দেখতে পায় ওর সাধের সোভিয়েত রাশিয়া এখন হিংসার আগুনে জ্বলছে। সাম্রাজ্যবাদী ক্ষুধায় আক্রান্ত রাশিয়া। রাশিয়া ইউক্রেনকে কবজা করতে চাইছে। ইউক্রেনও চাইছে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করতে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলছেন, এটা ওদের স্বাধীনতার লড়াই। দেশমাতাকে রক্ষা করার লড়াই। ফলে যুদ্ধ থামবে না, যুদ্ধ চলবে।
তিতির টিভির পর্দায় দেখেছে কিয়েভ শহর আক্রান্ত হবার দরুণ ওখানকার স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আতঙ্কিত হয়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। মেডিকেল পড়তে যাওয়া ছেলেমেয়েরা কাঁদতে কাঁদতে ওদের প্রকাশ করছে ইউক্রেনের এবং বিদেশি সংবাদদিকদের কাছে। তিতির আর দেখতে পারে না, টিভি বন্ধ করে দেয়।
এই পরিস্থিতিতে উৎসবদাকে ফোন করে পাওয়া যাচ্ছে না। উৎসবদার মা-এর কাছেও উৎসবদার থেকে কোনো ফোন আসেনি। ইউক্রেন এমব্যাসিতে গিয়ে বাবা ও ছোটকা উৎসবদার নাম, ঠিকানা, কলেজের নাম সব দিয়ে এসেছে। ভারত সরকারের থেকে সাহায্য চাওয়া হয়েছে। তবে কোথা থেকে কোনো খবর আজ পর্যন্ত আসেনি ওদের কাছে।
হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় তিতির যেন বোবা হয়ে যায়। ও পাগলের মতো শুধু ম্যাপ দেখে। মোবাইলে ইউটিউবে সার্চ করে ইউক্রেন দেখে, কিয়েভ শহর দেখে। ওখানকার সরকারের দেওয়া মৃত্যু তালিকা ঘাঁটে। তিতিরের এখন ম্যাপ দেখার গণ্ডি ছোট হয়ে গেছে। টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ওর সাধের সোভিয়েত দেশের থেকেও ছোট সে গণ্ডি, একদম বিন্দুর সমান। তিতির পাগলের মতো খুজে চলে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ শহরের ম্যাপ। যেখানে মেডিক্যাল পড়তে গেছে ওর উৎসবদা।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment