শৈশবের মহালয়া
একজন বয়স্ক মানুষ (অর্থাৎ বাড়ির বড়কর্তা নতুন ধুতি পরিহিত) বেঢপ সাইজের কাঠের রেডিয়োর পাশে জ্বেলে দিলেন কয়েকটা ধূপকাঠি। বাড়ির বড় গিন্নি বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে পেতলের থালায় বাতাসা, নকুল দানা, শিউলি ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিলেন ভক্তির উপাচার। এক লহমায় রেডিয়োটা যেন দেবতায় রূপান্তরিত হয়ে গেল সবার কাছেই। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে কচিকাঁচারা কানে-কানে ফিশফিশ করে অনুচ্চ স্বরে কথা বললেই বড়রা ধমক দিচ্ছে তর্জনী তুলে। একেবারে কড়া মিলিটারি শাসন।
গোটা পাড়ায় জমিদার বাড়িতে, একটা মাত্রই রেডিয়ো। তাই প্রায় মাঝরাত থেকেই উঠোন জুড়ে পাড়াপড়শিদের ভিড় উপচে পড়েছে; সবাই বসবার জায়গাও পায়নি। অগত্যা অনেকেই দাঁড়িয়ে রয়েছে আনাচেকানাচে। যেমনটা হয় নাটক দেখতে গেলে, যাত্রাপালা দেখতে গেলে। আর এই মাহেন্দ্রক্ষণেই কিনা মস্ত বড় রেডিয়োটায় শুধু বিকট আওয়াজ হচ্ছে ফর-ফর-ফর! অথচ এই সেকেলে মহার্ঘ যন্ত্রটা সকালেই সারিয়ে আনা হয়েছে। বাড়িতে এনে দশ-বারো বার বাজিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। তবু আসল সময়েই কোনও কথা বলছে না। সবাই টেনশনে কাঁপছে। কী হয়, কী হয় ভাব সবারই চোখে মুখে। হঠাৎ কলকাতা থেকে আসা বাড়ির মেজ কর্তা রেডিয়োটায় দু'তিনবার জোরে জোরে থাপ্পড় মারতেই শোনা গেল - 'আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা—' বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জাদুকরী কণ্ঠে 'মহিষাসুরমর্দিনীর' রেকর্ডিং শুনেই কচিকাঁচা-সহ সবার গায়েই কাঁটা দিয়ে উঠল। সেটা ছিল ষাট-সত্তরের দশকের ফেলে আসা সব সোনালি দিনের মধুর স্মৃতি।
তখন আকাশের জানালায় উড়ে যেত নীল মেঘের ভেলা দূর দিগন্ত পানে। তার দীঘল ছায়া আলপনা এঁকে দিত বাংলার নদনদী খালবিল হাওরের ফরসা জলে; সেই নীলাম্বরী মেঘের ছায়া দেখে পানকৌড়ি, বালিহাঁস ডুব দিত নদী জলে। পদ্ম, শালুক ফুলে ভরে যেত জলাশয়। দিগন্ত বিস্তৃত ধবল কাশের বনে উড়ে আসত লাল ফড়িং, রঙবেরঙের প্রজাপতির দল। ফসলের মাঠ থেকে গোরুর গাড়িতে করে চাষিরা ঘরে নিয়ে যেত রাশি রাশি পাকা সোনালি ধান, পাটের আঁটির বোঝা।
নীলকণ্ঠ পাখির উড়াল ডানায় চেপে বছর ভর প্রতীক্ষিত স্বপ্নের মহালয়ার দিনও এগিয়ে আসত কচিকাঁচাদের মনের জানালায়। সেই রথ যাত্রার দিন থেকে প্রতিমা তৈরির কারুকাজ দেখতে কুমোর পাড়ায় ভিড় জমতে শুরু করত খুদেদের।
মহালয়ার দিনটিই ছিল শৈশবের বাঁধনহারা অনাবিল আনন্দের দিন; মহালয়ার রাত্তিরে জেগে পাড়াপড়শির বাড়ি থেকে নারকেল, বাতাবি লেবু চুরি করে খাওয়ার আনন্দ ছিল আলাদা রকমের। ইস্কুলের মাঠে পেট্রোম্যাক্স হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে হত পিকনিকের আয়োজন। মহালয়া মানেই ইস্কুলে ছুটির পর্ব শুরু হয়ে যাওয়া। একদম দুগ্গা পুজো পর্যন্ত পড়া বন্ধ। সেই সময়ে পুজোর জামাকাপড় সবার নাই বা হল তাতে কারও খুব বেশি দুঃখ ছিল না মনে। প্রাণভরা ছিল মনের আনন্দ।
এখনও আকাশে নীল মেঘ উড়ে যায়। শিউলি ফুলের নরম গন্ধ ভেসে আসে শরতের নরম সুমন্দ বাতাসে। ফেলে আসা শৈশবের মহালয়াও স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠে নীরবে। দূরের আকাশে উড়ে বেড়ানো চোখ গেল পাখি চোখ গেল চোখ গেল বলে ডেকে যায় হৃদয়পুরে।
সমাপ্ত
খুব ভালো লাগল - জয়িতা
ReplyDeleteআপনার লেখা পড়ে এমনই অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল। খুব ভালো লাগলো। শারদীয় শুভেচ্ছা জানবেন।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো
ReplyDelete