প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

শেষ থেকে শুরু [৫ম পর্ব] | পারমিতা চ্যাটার্জি

বাতায়ন/সাপ্তাহিক/ধারাবাহিক/২য় বর্ষ/১ ৯ তম সংখ্যা/ ৩০শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ ধারাবাহিক উপন্যাস পারমিতা চ্যাটার্জি শেষ থেকে শুরু [৫ম পর্ব...

Tuesday, October 3, 2023

শারদ | শারদীয় দুর্গোৎসব এবং সমাজতাত্ত্বিক প্রসঙ্গ | সৌম্য ঘোষ

বাতায়ন/শারদ/প্রবন্ধ/১ম বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১৯শে আশ্বিন, ১৪৩০

শারদ | প্রবন্ধ
সৌম্য ঘোষ

শারদীয় দুর্গোৎসব এবং সমাজতাত্ত্বিক প্রসঙ্গ


"প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী— কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ!''
— কথাগুলি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের।

উৎসবের সম্মিলনে আমরা অর্জন করি ''আমরা'' হবার বোধ-উপলব্ধি! উৎসব তাই সবার জন্যই সতত সুখের এবং আনন্দের। এ এক মহৎ হবার সাধনা, বৃহৎ হওয়ার সংকল্প। উৎসব সবার মিলনের। সবাইকে যুক্ত করার মধ্যেই উৎসবের সার্থকতা।

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের গতানুগতিকতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে উৎসব জীবনকে রসালো, আনন্দঘন এবং প্রাণবন্ত করে তোলে। তাই উৎসব আমাদের কাছে এত কাঙ্ক্ষিত। প্রতিদিন অবশ্য উৎসব আশা করা যায় না, এলে ভালও লাগবে না।

ধর্মীয় উৎসব কিংবা অন্য যে কোনো সামাজিক সাংস্কৃতিক উৎসবের মূলে রয়েছে কল্যাণ কামনা এবং শুভবোধ। ধর্মীয় আচার-

-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা উচ্চারণ করি শুভ, সত্য, সুন্দর এবং কল্যাণের মন্ত্র। সেই মন্ত্রের বলে আমরা যেন অশুভ শক্তি বিনাশের মাধ্যমে সবার হৃদয়ে মানবধর্ম এবং মানবিক মূল্যবোধের উদ্‌বোধন ঘটাতে পারি, আজকের দিনে আমাদের সেটাই হোক প্রার্থনা! সভ্যতার অগ্রযাত্রা সুর বা শুভ, সত্য এবং সুন্দর প্রতিষ্ঠার সাধনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রতিটি ধর্মমতের আচার-

অনুষ্ঠান-রীতি-প্রথার একটা ইতিহাস আছে। আছে দার্শনিক বীক্ষা। দুর্গাপূজার সমাজতাত্ত্বিক দিকটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো সভ্যতাগুলোর অন্যতম 'হরপ্পা সভ্যতা'। সিন্ধু নদের অববাহিকার প্রাচীন নগর হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো এবং ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের ধোলাবীরা, কালবিজ্ঞান, রাখিগড়ি, রূপার এবং লোথাল প্রভৃতিকে নিয়েই 'হরপ্পা' সভ্যতা গঠিত।

প্রত্নতাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রাচীন বা আদি হরপ্পা নগরী খ্রিস্ট জন্মের ২ হাজার ৬শ' বছর আগের। অন্য নগরীগুলোও হরপ্পা সভ্যতার বিস্তৃতির প্রাচীনতম নিদর্শন। হরপ্পায় প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খননে (১৯২০ খ্রিস্টাব্দে) যে নিদর্শনগুলি পাওয়া যায়, তার একটি হলো মাটির মাতৃমূর্তি এবং অন্যটি স্বস্তিকা। মাতৃমূর্তি এবং হরপ্পা সভ্যতার অন্যান্য নিদর্শন বিশ্লেষণ করে প্রত্নতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ এবং সমাজতত্ত্ববিদরা একমত হয়েছেন যে, মাতৃমূর্তি হচ্ছে দ্রাবিড় এবং স্বস্তিকা হচ্ছে আর্য সভ্যতার নিদর্শন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আবিষ্কার এই হরপ্পা সভ্যতাটি ছিল মাতৃতান্ত্রিক। দেবীমূর্তি এবং দেবী পূজার আরও কিছু প্রত্ন নিদর্শন তারই প্রমাণ বহন করে। অতীতের ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত করে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী-নৃবিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন — হরপ্পা কেবল দ্রাবিড় নয়, এটি দ্রাবিড়, আর্য এমনকি অস্ট্রোলয়েড ও মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠীর মিলিত সভ্যতা।

কেউ কেউ এ জন্যই মাতৃবন্দনা বা দুর্গাপূজাকে হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার সমকালীন বলে মনে করেন। নিঃসন্দেহে প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতা মাতৃতান্ত্রিক ও নারীর কর্তৃত্বের নির্দেশক। তবে মাতৃদেবীর নামকরণ কী ছিল হরপ্পা সভ্যতা লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণ, কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং গীতার শ্লোকে দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু পুরাণ, রামায়ণ ও গীতার রচনাকাল বিবেচনায় নিলে, তা হরপ্পা সভ্যতার অনেক পরের বলেই ধরে নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে অন্তত দুই হাজার বছরের (খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ বছর আগের) ব্যবধান চোখে পড়বে। অতএব, দুর্গাপূজা আসলে হরপ্পান মাতৃপূজার স্মৃতির ছায়ামাত্র।

ভারতীয় সভ্যতায় দ্রাবিড়, অস্ট্রোলয়েড, আর্য, গ্রিক, পারসিক, শক, হুন এবং মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠীর বর্ণগত ও সংস্কৃতিগত মিথোস্ক্রিয়ার ফল হচ্ছে বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য। দুর্গার আদিরূপ যদি দ্রাবিড় হয়ে থাকে, তাহলে তার গাত্রবর্ণ কালো না হয়ে গৌরবর্ণ কেন? আবার তার অন্য রূপ 'কালো' (কালী দেবী) কেন? আর্য দেবতা শ্রীকৃষ্ণের গায়ের রং কালো বা শ্যামবর্ণ কেন? রাধিকা কেন গৌরবর্ণা? অনুমান করা যায়, স্থানীয় দ্রাবিড়, অস্ট্রোলয়েড এবং বহিরাগত আর্য সভ্যতার মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে এক ধরনের মিথোস্ক্রিয়ার হয়েছে। চমৎকার একটা দার্শনিক ঐক্যসূত্র উদ্ভাবিত হয়েছে। ঈশ্বর বা ভগবান, যে কোনো রূপে, যে কোনো বর্ণে এবং যে কোনো লিঙ্গে আবির্ভূত হন। তাই যিনি দুর্গা, তিনিই কালী। আবার সত্তার দিক থেকে তিনিই শিব। যিনি কৃষ্ণ, তিনিই রাধা। অভিন্ন সত্তার ভিন্নরূপে আত্মপ্রকাশ। কার্যকারণটি কিন্তু একেবারেই জাগতিক। কালো-শ্যাম বর্ণের দ্রাবিড়দের ওপর আর্যদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার কৌশল হচ্ছে এক ধরনের আপস। কৃষ্ণের কালো রূপ তাকে সর্বভারতীয় দেবতার আসনে আসীন করেছে। তেমনই শ্বেতকায় শিবের সঙ্গে কালীর বন্ধন। সবটাতেই বৈদিক প্রভাব।

মাতৃপূজা বা দুর্গাপূজা যদি মাতৃতান্ত্রিকতার সাক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে আজকের দাক্ষিণাত্যে এবং আর্যাবর্তে (উত্তর ও পশ্চিম ভারত) এই দেবী পূজার প্রচলন হলো না কেন? দাক্ষিণাত্যে গণেশ এবং আর্যাবর্তে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাম কেন প্রধান দেবতারূপে আবির্ভূত? ধর্মতত্ত্ববিদ এবং সমাজতত্ত্ববিদরাই এর সঠিক উত্তর দিতে পারবেন। হতে পারে আর্য সভ্যতা পুরুষতন্ত্রে পরিণতি লাভ করায় নারী রূপের দেবী সেখানে গৌণ। দ্রাবিড়দের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য।

প্রশ্ন হচ্ছে— বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, অসম, ত্রিপুরা এবং ঝাড়খন্ড অঞ্চলে দুর্গার এমন একচ্ছত্র প্রভাব কীভাবে হলো? এছাড়া হিন্দুপ্রধান দেশ নেপালেও এটিই সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। এসব অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রধান ধর্মীয় উৎসবে পরিণত দুর্গাপূজা। অন্য অঞ্চলের কথা না হয় বাদই দিলাম। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে অর্থাৎ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা, ওড়িশা, ঝাড়খন্ড, উত্তর প্রদেশ (পূর্বাঞ্চল) এবং বাংলাদেশে 

ঐতিহ্যগত বিশেষভাবে উদ্‌যাপিত হয়। এটি বাংলা বর্ষপঞ্জির আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। সর্বোপরি ভারত ও পৃথিবীর সর্বত্র, যেখানেই বাঙালিদের বসতি, সেখানে দুর্গাপূজা প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। এর নেপথ্যে ধর্মীয়, সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক কার্যকারণ কী হতে পারে?

আমি ধর্মতত্ত্ববিদ বা সমাজতত্ত্ববিদ নই। ইতিহাসবিদও নই। সাহিত্যের অনুসন্ধিৎসু। এবং ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের অনুসন্ধিৎসু পাঠক। সম্ভবত ভুল হবে না, যদি বলি প্রাচীনকালে অস্ট্রোলয়েড জনবসতি বাংলা অঞ্চল মাতৃতান্ত্রিক ছিল। দ্রাবিড় ও আর্যরা মাতৃতান্ত্রিকতাকে পরাভূত ও পরিহার করলেও বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা অঞ্চলে মাতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব বহুদিন অক্ষুন্ন ছিল। এসব অঞ্চলে হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, বিশেষত মহাজনপন্থায় অনেক দেবীর আবির্ভাব ঘটে। হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মমতে দেবীবন্দনাই মুখ্য হয়ে দেখা দেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংস্কৃত ভাষায় রচিত মূল রামায়ণে দুর্গা পূজার কোন উল্লেখ ছিল না। কিন্তু রামায়ণ যখন বাংলা ভাষায় অনুদিত হয় মূলত তখন থেকেই দেবী হিসাবে দুর্গার মাহাত্ম্য বাঙালিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ছয়শো বছর আগে কৃত্তিবাস ওঝা যখন রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করেন, তখন লোকায়ত গল্পে যেখানে দুর্গার কাহিনি প্রচলিত ছিল, সেটি তিনি তাঁর রচিত রামায়ণে অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি। এভাবেই দুর্গা প্রধানতম দেবী হিসাবে আবির্ভূত হন বাঙালি হিন্দুদের কাছে। কিন্তু এরপরও প্রধান ধর্মীয় উৎসব হয়ে উঠতে দুর্গা পূজার সময় লেগেছে আরো কয়েক শো বছর। দুর্গা পূজার সময় হিসাবে শরৎ কালকে বেছে নেবারও কারণ ছিল, যেহেতু এটা কিছুটা অঞ্চলভিত্তিক পূজা, এই সময়ে বৃষ্টি তেমন হয় না। তাছাড়া এটা নবান্নের সময়, এ সময় ধান ও অন্যান্য শস্য ওঠে, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকে। ফলে মানুষ আনন্দ করতে পারে।

বাঙালি হিন্দুর সর্বপ্রধান এবং সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আমরা দুর্গাপূজা বললেও আসলে এই পূজা মা-দুর্গার একার নয়। সঙ্গে আরও অনেকেই আছেন। মা দুর্গা আসেন সবাইকে নিয়েই৷ ভালো-মন্দ, শত্রু-মিত্র, গাছ-প্রাণী সঙ্গে নিয়েই৷ চালচিত্রে শিব আছেন, তো পায়ের নীচে অসুর৷ নবপত্র (কলা বৌ), পেঁচা, হাঁস, ইঁদুর, ময়ূর সকলে৷ হাসিকান্না, সুজন-দুর্জন, পশুপাখি-উদ্ভিদ সমাহারে আমাদের জীবন-পথ চলাটাকেই সহজ করে চিনিয়ে দিতে চান৷ শরৎঋতুতে আবাহন হয় বলে দেবীর আরেক নাম শারদীয়া। এছাড়া মহিষাসুরমর্দিনী, কাত্যায়নী, শিবানী, ভবানী, আদ্যাশক্তি, চণ্ডী, শতাক্ষী, দুর্গা, উমা, গৌরী, সতী, রুদ্রাণী, কল্যাণী, অম্বিকা, অদ্রিজা এমন কতশত নাম আছে মায়ের।

তাহলে দুর্গা কে? তিনি এক দেবী। দেবী কে? এক শক্তি। শক্তি কী? কাজ করার ক্ষমতা। আমরা যে কথা বলি, কথা একটা কাজ। দেখি, শুনি, বুঝি এগুলোও কাজ। শক্তি ছাড়া কাজ হয় না। এই শক্তি 'কথন শক্তি', 'শ্রবণ শক্তি', 'দৃষ্টি শক্তি', 'বোধ শক্তি', 'চৈতন্য শক্তি'। সামগ্ৰিকভাবে মহাসরস্বতী।

আমাদের অন্তর্জগতে যে নিরন্তর শুভ ও অশুভের সংগ্রাম চলছে এবং সেই সংগ্রামে আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি। তার বাস্তবতা আমরা কেমন করে অস্বীকার করব? এই সংগ্রাম যেমন অনাদি, তেমনই আপেক্ষিক বিচারে তা অনন্তও এবং এই সংগ্রাম পুরাণ-কথিত সংগ্রামের চেয়েও কঠিনতর। যতদিন সৃষ্টি থাকবে ততদিন মানুষের মধ্যে এই সংগ্রাম চলতে থাকবে। দুর্গা ও মহিষাসুরের যুদ্ধ তেমনই মানুষের মধ্যে শুভ ও অশুভের চিরন্তনযুদ্ধের প্রতীক।

উনিশ শতকে বাঙালি রেনেসাঁ, বিশেষত সমাজ সংস্কার হিন্দুধর্মকে মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে আলোকোজ্জ্বল পথে টেনে আনে। রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সতীদাহ প্রথা নিবারণ, বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণ, বিধবা বিবাহ চালু এবং ধীরে ধীরে বাল্যবিবাহ হ্রাসের মধ্য দিয়ে নারীর মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালির নবজাগরণ নারী শিক্ষার দুয়ারও খুলে দেয়।

বাংলাভাষী অঞ্চলে দুর্গার আরেক রূপ আমরা লক্ষ্য করি উনিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায়। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে দুর্গাকে দেশমাতৃকারূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। তরুণদের দেশমাতৃকার মুক্তিসাধনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য উপন্যাসের 'বন্দে মাতরম্‌' গান বিংশ শতাব্দীতে এসে ভারতের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করে। এই গান এবং দেশমাতৃকারূপে দুর্গাবন্দনা ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের পবিত্র মন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। ১৯০৫ সাল থেকে সূচিত অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর প্রভৃতি গুপ্ত সংগঠনগুলো (ব্রিটিশদের ভাষায় 'সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন') হাজার হাজার তরুণকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের মরণজয়ী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে। গুপ্ত সংগঠনগুলো শক্তিরূপেণ এবং অসুরবিনাশিনী মা দুর্গা অথবা শক্তির আধার কালীমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আত্মদানের শপথ গ্রহণ করত।

ধর্ম নিরপেক্ষ ভারত রাষ্ট্রীয় ভাবে বিভাজনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। ফলে 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার এবং ধর্ম যার যার, উৎসব সবার'- এই চেতনা প্রবলতর হয়। শারদীয় দুর্গোৎসব তাই সার্বজনীন ও সর্বমানবিক দ্যোতনা লাভ করছে। দুর্গোৎসব ধর্মে ধর্মে মানুষে মানুষে বর্ণে বর্ণে জাতিতে জাতিতে সম্প্রীতির মেলবন্ধন গড়ে তুলুক- এই কামনা করি।

আমাদের সমাজে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সম্প্রীতিকে রক্ষা করতে হবে। জাতিগত, বর্ণগত, ধর্মগত বিভেদকে তুচ্ছ করে সকলের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনকে জোরালো করতে হবে। সকলের প্রতি সহযোগিতা, সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক সকলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেন সকলের ভেতর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটে। আর তা হলেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। আর এর দায়-দায়িত্ব নিতে হবে আমাকে-আপনাকে, আমাদের সকলকে। দেবী দুর্গার আদর্শও কিন্তু সমন্বয়ের; সবাইকে নিয়ে, সবার জন্য।

 

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)