চিনু
হরেন্দ্রনাথ দেখেন, প্রতিমাশিল্পীটি বছর কুড়ির এক সুদর্শন যুবক। তাকে দেখেই চমকে গেলেন হরেন্দ্রনাথ। এমন মুখশ্রী তিনি আগেও দেখেছেন। কোথায় এবং কবে দেখেছেন সে-সব কিছুই মনে করতে না পেরে স্মিত হেসে যুবককে শুধোন– শিল্পী তোমার নাম কী?
যুবক সহাস্যে জবাব দেয় – আমার নাম শিবশঙ্কর পাল।
কৌতূহল দমন করতে না পেরে হরেন্দ্রনাথ শুধোন – তুমি আগে কখনো এসেছিলে আমাদের গ্রামে?
জবাবে শিবশঙ্কর বলে – আজ্ঞে জমিদারবাবু, আমি এই প্রথম এলাম। বীরেন্দ্রনাথবাবু আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমার বাবাকে। কিন্তু তিনি না এসে আমাকেই পাঠিয়ে দিলেন আপনাদের দুর্গা প্রতিমা গড়ে দেবার জন্য।
শুনে হরেন্দ্রনাথ চিন্তিত গলায় বলেন – তোমার কতই বা অভিজ্ঞতা হয়েছে! পারবে কী মূর্তি গড়ে দিতে?
শিবশঙ্কর হেসেই জবাব দেয় – বাবা নিজে হাতে ধরে আমাকে শিখিয়েছেন এই কাজ। কথা দিচ্ছি, আপনার মনের মতো প্রতিমা গড়ে দিয়ে যাব।
হরেন্দ্রনাথ তবুও দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলেন – পারবে বলছ? দেখো চেষ্টা করে।
***
মূর্তি গড়ার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আজ তন্ময় হয়ে মা-দুর্গার মৃন্ময়ী চোখে তুলির টান দিচ্ছে শিবশঙ্কর। যুবক শিল্পীর কর্মদক্ষতা দেখে হরেন্দ্রনাথ মনে-মনে তারিফ না করে থাকতে পারলেন না, ‘নাহ্, যুবক ভালই কাজ শিখেছে। তবে কে কত উঁচু দরের শিল্পী সেটা নির্ভর করে মা-দুর্গার চোখ দুটোয় শিল্পীর তুলির টান দেবার ওপর।
নাটমন্দির থেকে দরদালানে ফিরে এসে হরেন্দ্রনাথ গা এলিয়ে দিলেন আরামকেদারায়। বিশ্বস্ত চাকর সুদামা গড়গড়া সাজিয়ে নিয়ে এসে গড়গড়ার নলটা হাতে ধরিয়ে দিতে হরেন্দ্রনাথ ‘গুড়ুক-গুড়ুক’ শব্দ তুলে হালকা মেজাজে তামাক সেবনে মন দিলেন। এমন সময়ে প্রপৌত্র ছয় বছরের বালক নরেন্দ্রনাথ এসে হরেন্দ্রনাথকে শুধোলো – মা-দুর্গা কেন মহিষাসুরকে নিধন করেছেন দাদাভাই?
হরেন্দ্রনাথ প্রপৌত্রকে সংক্ষেপে শোনালেন সেই চিরপ্রচলিত পৌরাণিক কাহিনিটি। কালিকা পুরাণের মতে, সত্যযুগের প্রথম দিকে যোগনিদ্রা মহামায়াই পরাক্রমশালী মহিষাসুরকে বধ করেন ভদ্রকালী রূপে। দেবতাগণ তখন হিমালয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন কাত্যায়ন মুনির আশ্রমে।
প্রথম মহিষাসুর নিহত হলেও সেখানে অপর এক মহিষাসুর উপস্থিত হয়ে দেবতাগণের ওপর অত্যাচার শুরু করায় ক্রুদ্ধ দেবতাগণের পূতদেহ থেকে জ্যোতি পুঞ্জীভূত নির্গত হয়ে অমিততেজা দেবীমূর্তির রূপ ধারণ করে দ্বিতীয় মহিষাসুরকে নিধন করেন। দ্বিতীয় মহিষাসুর কাত্যায়ন মুনির শিষ্য হলেও গুরুরই অভিশাপে সিংহবাহিনী দশভূজা দেবীর হাতে নবমী-তিথিতে নিধন হন। এই দেবীকে প্রথম পুজো করেন স্বয়ং কাত্যায়ন মুনি। তাই এই অমিততেজা দেবীর নাম হল কাত্যায়নী।
বালক নরেন্দ্রনাথ আবারও প্রশ্ন করে – মহিষাসুর তো অসুর, তাই না দাদু?
হরেন্দ্রনাথ মৃদু হেসে জবাব দেন – অসুরই তো দাদুভাই।
তাহলে মা-দুর্গার সঙ্গে মহিষাসুরেরও পুজো করা হয় কেন?
শোনো তাহলে। দ্বিতীয় মহিষাসুর স্বপ্নে দেখেছিলেন এক দেবী রক্ত পান করছেন তাঁর মুণ্ডচ্ছেদ করে। সেই স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে তিনি সেই দেবীর পুজো করে দেবীকে তুষ্ট করে। দেবী তুষ্ট হয়ে তাঁকে বর দিতে চাইলে দ্বিতীয় মহিষাসুর বললেন, তিনি যেন যজ্ঞভাগের অধিকার লাভ করেন দেবীর পদসেবক হয়ে থেকে। তখন ভদ্রকালী রূপে আবির্ভূতা হয়ে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বলেন, ‘তুমি যজ্ঞভাগের অধিকারী হবে না ঠিকই তবে পদসেবক হয়ে মর্ত্যে আমার সঙ্গে পূজিত হবে।’ সে-কারণেই মা-দুর্গার পায়ের কাছে স্থান পেয়েছে দ্বিতীয় মহিষাসুর।
পুরাণের কাহিনি শুনে বালক নরেন্দ্রনাথ খুশি মনে ফিরে গেল অন্দরমহলে। তামাক সেবন করতে করতে হরেন্দ্রনাথ ডুবে গেলেন নিজেরই শৈশব এবং সদ্যযৌবনকালের দিনগুলিতে। সে-সব দিনে জমিদারবাড়ির প্রতিমা গড়তেন অঘোরপুরেরই সুদক্ষ প্রতিমাশিল্পী সুখরঞ্জন পাল। মূর্তি গড়ার দিনগুলোয় সঙ্গে আনতেন নিজেরই মাতৃহারা সুন্দরী বালিকা চিনুকে। বালক হরেন্দ্রনাথ সে-সব দিনে ছোঁয়াছুঁয়ি, কানামাছি, লুকোচুরি… ইত্যাদি কত খেলাই না খেলেছেন বালিকা চিনুর সঙ্গে।
দেখতে দেখতে তাঁরা একদিন প্রবেশ করলেন যৌবনকালে। যৌবনাবতী চিনুর রূপের আগুনে যেন ঝলসে গেছিল যুবক হরেন্দ্রনাথের চোখ। তিনি সর্বদা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতেন চিনুর দিকে। তেমন দিনেই হরেন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন নিজের অজান্তেই চিনুকে ভালবেসে ফেলেছেন। মনস্থও করে নিয়েছিলেন বিবাহ করলে চিনুকেই করবেন, নচেৎ এই জীবনে আর বিবাহ করবেন না। কিন্তু তাঁর সেই বাসনা অপূর্ণই থেকে গেল।
জমিদার পিতা কৃষ্ণেন্দ্রনাথ চৌধুরী কখনোই চাননি তাঁর একমাত্র পুত্রের বিবাহ হোক সামান্য এক জন মৃতশিল্পীর কন্যার সঙ্গে। পরিণামে সুখরঞ্জন পালকে রাতারাতি সপরিবারে ভিটেছাড়া হতে হয়েছিল। বিদায়বেলায় রূপসী চিনু কান্নাভেজা আয়ত চোখ দুটো কাঁপিয়ে দিয়েছিল যুবক হরেন্দ্রনাথের হৃদয়। পিতার ওপর কথা বলার সাহস দেখাতে পারেননি বলে আজও হাত কামড়ান হরেন্দ্রনাথ। এর পর অনেক খুঁজেও চিনুর কোনো সন্ধানই পাননি হরেন্দ্রনাথ। সেইদিন চিনুর ওই সজল আয়ত চোখ দুটো আজও তাড়া করে ফিরছে তাঁকে।
মূর্তি গড়ার কাজ শেষ হতে হরেন্দ্রনাথের সামনে এসে শিবশঙ্কর বিনীত গলায় বলে – এবার দেখে বলুন জমিদারবাবু, মা-দুর্গার প্রতিমা আপনার মনের মতো হয়েছে কিনা?
নাটমন্দিরে এসে মা-দুর্গার মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে গেলেন হরেন্দ্রনাথ। চিনু যেন মৃন্ময়ী রূপে এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে! শিল্পী মা-দুর্গার আয়ত চোখ দুটিও এঁকেছে অবিকল চিনুর মতো করে! হতবাক হয়ে প্রতিমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একসময়ে স্খলিত গলায় শিবশঙ্করকে শুধোন – মা-দুর্গার এই মুখ কি তোমার কল্পনাপ্রসূত শিল্পী?
জবাবে শিবশঙ্কর বলে – নাহ্ জমিদারবাবু। আমার ঠাকুমার মুখের আদলে গড়েছি এই মুখ। অঘোরপুর গ্রামে দুর্গা প্রতিমা গড়তে আসছি শুনে আমার ঠাকুমা ঠিক এমন চোখেই তাকিয়েছিলেন আমার দিকে। এক কালে খুবই রূপসী ছিলেন তিনি। আজও তাঁর রূপের জৌলুসে বিশেষ ভাটা পড়েনি! ভেবেছিলাম, অমন একটা মুখ ফুটিয়ে তুলতে পারলে আপনি আর চোখ ফেরাতে পারবেন না। সেই ভেবেই ঠাকুমার মুখটাই ফুটিয়ে তুলেছি মা-দুর্গার মৃন্ময়ী মুখে। সবাই বলে আমি নাকি ঠাকুমার চেহারার কিছুটা অন্তত পেয়েছি। শিবশঙ্করের কথা শুনে হরেন্দ্রনাথ আবারও চমকে গেলেন। এই কারণেই যুবকটিকে কী আগে কোথাও দেখেছেন বলে মনে হচ্ছিল তাঁর? এই মুহূর্তে শিল্পীর ঠাকুমার নাম জানতে খুব ইচ্ছে করলেও দ্বিধাগ্রস্ত হরেন্দ্রনাথ শুধোতে পারছেন না তাকে। যুবক যদি চিনুর বদলে অন্য কোনো নাম বলে বসে সেই ভয়েই ব্যথাতুর দৃষ্টিতে...
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment