নীল আগুনরেখা
গ্রহনক্ষত্রের প্রমত্ত প্রভাবে এ আমি কোথায় এসে পড়লাম! কী নীরন্ধ্র অন্ধকার! আমাকে ঘিরে ধরেছে আশ্চর্য অন্ধকার, বস্তুহীন এক কৃষ্ণসমগ্রের ভিতর যেন আমি ভাসছি! এইই কী তবে মহাশূন্য! মাঝে মাঝে গায়ে ছিটকে এসে পড়ছে অদৃশ্য নক্ষত্রের রেণু! আমার চোখের সামনে মনে হচ্ছে কোটিকোটি অন্ধকারের পর্দা টাঙানো। সেই অন্ধকারের পর্দা মুচড়ে শোনা যাচ্ছে অদ্ভুত ভয়ঙ্কর শব্দ। যে শব্দের ধ্বনি কোনো জাগতিক কেন্দ্রের নয়, সে ধ্বনি কখনও ইতিপূর্বে শুনিনি। সে শব্দ আমাদের লৌকিক জগতের শ্রবণগম্য নয়! সে শব্দের ধ্বনি না কোনো প্রাণীর, না কোনো বনানীর, না প্রকৃতির মুখ নিঃসৃত বাণী! বোধহয় মহাব্যোমের নিজস্ব ধ্বনি বৃত্তান্ত! সেই শব্দের ভার আমি সহ্য করতে পারছি না। সেই শব্দের তীব্রতায় আমি ক্রমে হয়ে পড়ছি প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্য, হয়ে পড়ছি শিথিল ঘুমের পঙক্তি। কতক্ষণ নিস্তেজ, নীরব ছিলাম জানি না। চেতন ফিরতে দেখলাম আমি শুয়ে আছি পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকারের কুয়াশার ভিতর। আমার সমস্ত দেহ একেবারে বরফশীতল। শরীরটা বিমর্ষ শীতে জমাট বেঁধে গিয়েছে। কে যেন দয়াপরবশ হয়ে আমার মাথার ধারে রেখে গিয়েছে গোলাকার একটি মোমবাতি। যে মোমবাতির শিখা সম্পূর্ণ নীল। মোমবাতিকে ঘিরে গোলাকার নীল একটি আগুনের বলয়। হিম কণ্ঠে কাঁপতে কাঁপতে বলি– এমন গাঢ় নীল আগুনের রশ্মি কক্ষনো দেখিনি! এ যে চিন্তার অতীত!
এমন নীল আগুন তো তারাই দেখে যারা জীবন ও মৃত্যুর মাঝে নিরবয়ব শূন্যতায় ডুবে যায়। তবে কী আমার মৃত্যুর সময় আগত! কথাগুলো ভাবতেই আমার ভিতরের কঙ্কাল কেঁপে ওঠে। পঞ্চভূত সমন্বিত এ-দেহের হাড়-পাঁজরে এমন ঘোর যুদ্ধ বাধল যে তাদের যুদ্ধের তূর্যনিনাদে মহাব্রহ্মাণ্ড থেকে যেন ছিটকে এসে পড়লাম নিরুচ্চার এক ধুলোর স্তূপে। দূর! ধুলো কোথায়! কোথায় বা মহাশূন্য! আমি তো শুয়ে আমার নিজ দেহের আবহে!
ডাহুকীর মসৃণ পালকের মতো চকচক করছে রাত্রিদেবীর শরীর। রূপদক্ষ ঈশ্বর কী নিপুণতায় গড়ে তুলেছেন দেবীর নগ্ন নিরঞ্জন দেহকাঠামো! অসংখ্য নক্ষত্রখচিত মুকুট মাথায়। কপালে উজ্জ্বল স্বর্ণচাঁদ। এক ঢাল ভ্রমরকালো চুলে ঢেকে আছে চারিদিক। কণ্ঠ জড়িয়ে সুবাসিত কুসুমমালা। পীনোন্নত স্তনভাণ্ড থেকে অনর্গল নির্গত হচ্ছে দুধসাদা কুয়াশা। বামহাতে অদ্ভুত এক নীলচে আলোর শিখা ডানহাতে আড়াল করে এমন ভাবে ধরে আছেন যে নাভিপদ্মের পর হতে সবটুকু আবছা, অস্পষ্ট। রাত্রিদেবী তাঁর ডালিম ওষ্ঠে মৃদু স্বরে গুনগুন করে ঘুমপাড়ানি গান গাইছেন। সেই গানের ভিতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে মিহি জ্যোৎস্না। অপার্থিব সে গানের মূর্ছনায় জগতসংসার ঘুমিয়ে। কেবল আমার চোখে ঘুম নেই। দেখে চলেছি এমন স্বর্গীয় দৃশ্য। গান গাইতে গাইতে দেবী যেন ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়ছেন। একসময় সেই মধুর ঘুমপাড়ানি গান আর শুনতে পাচ্ছি না। তাঁর মাথার মুকুট ক্রমে শ্বেতশুভ্র রূপ ধারণ করছে, কপালে ফুটে থাকা শশীমুখী মূর্ছিত হয়ে পড়ছে। রাত্রিদেবী অতিকষ্টে আমার দিকে একবার তাকান। মৃদু হেসে হাতের আলোকশিখা থেকে আড়াল সরিয়ে দেন।
এ কী! এ তো সেই গোলাকার মোমবাতি! দেবীর হাতের মোমবাতির নীল অগ্নিশিখা ক্রমশ লালচে হতে হতে বিরাটাকার ধারণ করে। আর সেই আগুনের হল্কায় রাত্রিদেবী গলতে গলতে নিঃশেষিত হওয়া মাত্রই পুব আকাশে ভোরের সূর্যোদয়। দূর হতে শোনা যাচ্ছে রাগাশ্রিত আজানের সুর। যদিও আমার বোধের নির্বাণ তীর্থে তখনও দাঁড়িয়ে একনিষ্ঠ বিশ্বাস, দাঁড়িয়ে মৃত্যু, দাঁড়িয়ে চিতার নীলঘোর আগুন, রাত্রিদেবী, দাঁড়িয়ে অসীম অনন্ত। অন্যতর ভালবাসায় বয়ে চলেছে সোমেশ্বরী নদী। আমি তাদের প্রত্যেককে প্রণাম জানিয়ে প্রতিদিনের মতো লিখতে বসি। ফুলদানিতে কে রেখে গেল অমন সুন্দর একগুচ্ছ গোলাপরশ্মি! আমার সাদা পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি জুড়ে তখন কী পঙক্তির বিচ্ছুরণ! চারিদিকে কী অনৈসর্গিক আলো! হৃদয় মেলে দেখি – ধ্বনিহারা কবিতারা অপরূপ অনুরাগে ফুটে উঠছে সেই ফ্লাওয়ারভাসের গোলাপি পাপড়িধামে…
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment