প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Saturday, July 6, 2024

সাহিত্য— নির্মাণ ও নেপথ্য কথা—২ | জয়িতা ভট্টাচার্য

বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/প্রবন্ধ/২য় বর্ষ/৬ষ্ঠ/যশোধরা রায়চৌধুরী সংখ্যা/২১শে আষাঢ়, ১৪৩১

যশোধরা রায়চৌধুরী সংখ্যা | প্রবন্ধ

জয়িতা ভট্টাচার্য

সাহিত্য— নির্মাণ ও নেপথ্য কথা— ২


"আমরা দেখি এক সামান্য নারী কীভাবে উত্তরণ ঘটাতে পেরেছিল এক সাধারণ কবি থেকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিরূপে, জন কিট্‌স।"


[প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ লেখিকার নিজস্ব মতামত।]

মৌলিক সাহিত্য বলে তেমন কিছু গোড়া থেকেই ছিল কিনা সংশয় থাকে সেজন্য স্ক্যাণ্ডিনাভিয়া থেকে আসা উত্তর পুবের ইয়োরোপে এই যে অসুরনিধন কাহিনিটি প্রাচীন জার্মান মিশ্রিত ভাষায় লেখা বলে বলা হয় প্রাচীনতম সাহিত্য বেউলফ তাও তো অ্যাংলো ফ্রিশান উপজাতি লোককথা থেকে স্রেফ টোকা। খ্রিস্ট ধর্মের মোড়কে পেগান রূপকথা এবং 
রাজকাহিনি। ক্ষমতার ইতিকথা। বেউলফ থেকে বোদলেয়ার এক দীর্ঘ পথ। আসবেন শেকসপিয়র, মিলটন, শেলি বা জন 
কিট্‌স। "সত্যই সৌন্দর্য, সৌন্দর্যই সত্য" বলেছিলেন ক্ষণজন্মা ইংরেজ কবি জন কিট্‌স।
রাজার গল্প আর রাক্ষস বধ পালা আবার পরে বলছি।
কথা হচ্ছিল সাহিত্য ক্ষেত্রে নারী পুরুষের জটিল সম্পর্কের কথা নিয়ে। প্রশ্ন সফল কবির জীবনে প্রেম তা সমাজ স্বীকৃত না হলেও তা কী অনিবার্য! তা কি আবশ্যক? কালে কালে কবিকুলকে যা বিস্তর প্রভাবিত করেছে। কবিতার মোড় এবং জনার। নতুন প্রেম বা বিরহ বদলে দিয়েছে কবিতার ভাষা। বদলে দিয়েছে কবির মননের প্রবাহ। ইংরেজ কবি জন কিট্‌সের কথাই ধরা যাক।
জন কিট্‌স যে এত সৌন্দর্যের পুজারি ছিলেন তাঁর জীবন অথচই অনেক কাল পর্যন্ত ছিল নারী বর্জিত, মলিন, একঘেয়ে নিম্নচাপের বৃষ্টির মতো। বিবাহ বা প্রণয়ে বিশ্বাসহীন জন কিট্‌স কিংবা সংশয়পূর্ণ। যে কোনও সভায় তাই যখন তাঁর সমসাময়িক কবিরা সকলেই একাধিক নারী সঙ্গে জড়িত তিনি একা একা এক কোণে বসে আছেন গ্লাস হাতে। জন কিট্‌স, জন্ম ২৩ অক্টোবর ১৭৯৫, লন্ডনের মুর্গেট মফস্‌সলে। চোদ্দো থেকে আঠারো বছর বয়স অবধি তেমন কোনও কবিতাও তিনি লিখে উঠতে পারেননি অন্তত সাহিত্য মহলে পাত্তা পাচ্ছেন না।
অথচ কিট্‌স রোমান্টিক যুগের কবিদের অন্যতম, তাঁর সমসাময়িক কবিরা হলেন বায়রন এবং শেলি। কিন্তু কিট্‌সের শৈশব স্বস্তির ছিলো না। দরিদ্র সংসারে মাত্র আট বছর বয়সে বাবা মারা গেলেন অপঘাতে। ঘোড়া থেকে পড়ে মাথার খুলি ভেঙে। যে ঘোড়ার আস্তাবলের তিনি সামান্য কর্মচারী। ঠিক তার দু-তিন মাসের মধ্যেই মা ফের বিবাহ করলেন। তাঁদের চার ভাই বোনের ঠাঁই হলো দিদিমার কাছে। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে মায়েরও মৃত্যু হলো। আমৃত্যু কবি দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতে লিখছেন।
ভালবাসায় বিশ্বাস হারিয়েছেন। মহিলা সংসর্গ এড়িয়ে চলেন, তাঁরা যেন অন্য জগতের কেউ। কুণ্ঠিত হয়ে এক কোণে বসে থাকেন নিজস্ব ব্যথা সম্বল করে। এভাবেই টুকটাক কবিতা লেখা চলছিল। তাঁর প্রথম কবিতা একাকীত্বের সনেট, নৈঃশব্দের সনেট, The sonnet o Solitude. এক্সামিনারে প্রকাশিত হয় মে ১৮১৬। তাঁর অন্য কবিতাগুলো যেমন লামিয়া, ইসাবেলা, ইভ অফ সেন্ট এগনেস প্রভৃতির সংকলন প্রকাশিত হলো জুলাই ১৮২০ শেষবার রোম সফরের আগে। আর তারপর তাঁর স্বল্প জীবনের শেষ পর্বে আমরা দেখলাম তাঁর জীবনে এলেন এক নারী আর বদলে গেল সব। ফ্যানি ব্রাউন। সাধারণ মধ্যবিত্তর মেয়ে লন্ডনে বাস। অথচ এই রমণীর জন্য কিট্‌স হয়ে গেলেন যুগান্তরের কবি।
আঠারো বছর বয়সে মারা গেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। টিবি রোগে। আঠারো বছর বয়সে কিট্‌স পেলেন তাঁর নারীকে। আর তারপর তাঁর কলম থেকে একে একে বেরিয়ে এলো— দ্য ইভ অফ সেন্ট এগনেস, ওড্ টু এ নাইটিঙ্গল, লামিয়া প্রভৃতি। মাত্র কয়েক বছর কিট্‌স তাঁর জীবনে পেয়েছিলেন ফ্যানিকে কারণ মাত্র আঠারো বছর বয়সে টিবি রোগে অকালে চলে যেতে হলো কবিকে।
কিট্‌স সনেটকে স্পেনসারিয়ান সনেট থেকে, মিলটনিয়ান সনেট থেকে মুক্ত করে এক অধ্যায়ের সূচনা করলেন। রোমান্টিসিজম পেরিয়ে এক নব উদ্যম, মানুষের হৃদয়ের যাবতীয় দ্বন্দ্ব, ক্ষরণ, আর প্রত্যাশার কথা প্রকাশিত হলো তাঁর সনেটে। আত্মসন্ধান আর আশ্চর্য বৌদ্ধিক ও কৌতুকের ঝলক। যে টিউবারকুলোসিস তাঁর মা ও দুই ভাইবোনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল তখনও পর্যন্ত সেই রোগের টিকা অনাবিষ্কৃত। টিবি রোগগ্রস্ত জন কিট্‌সকে শুশ্রূষা করতে এলেন ফ্যানি ব্রাউন, হ্যামস্টিড। আর তারপর সেই অমর প্রেম।
১৮২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রোমে মৃত্যুর পর সেই অনির্বচনীয় স্বর্গীয় চিঠিগুলি পাওয়া যায় যা তিনি রোগশয্যায় শুয়ে লিখেছেন প্রেমিকা ফ্যানি ব্রাউনকে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অধিকাংশ কবিতা বই মুদ্রিত এবং পুনর্মুদ্রিত হতে থাকল এবং সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম। এ যেন তাঁরই লেখা "দ্য ফল অফ হাইপেরিয়ন: এ ড্রিম" স্বপ্ন ও সার্থকতার এক দীর্ঘ কাব্য। টিবি না দারিদ্র্য আসলে কীসে তাঁর মৃত্যু! অথচ ভাগ্যের পরিহাস এই যে তাঁর মা যথেষ্ট সম্পত্তি উইল করে যাযকদের অছি করে গেছিলেন যাতে কিট্‌সের ভাগে যে সম্পত্তি আসত তাতে তিনি সুস্থ সুন্দর জীবন পেতেই পারতেন। অথচ কিট্‌স সেই তথ্য জানতে পারলেন না। তাঁকে বলা হয়নি। কী হলে কী হতো ভেবে লাভ না হলেও আমরা তো চর্চা করেই থাকি। তাই আজও সমস্ত বিশ্বের কিট্‌স প্রেমীদের এই আপশোশ যদি ফ্যানি ব্রাউন তাঁর যৌবনের শুরুতেই আসতেন কিট্‌স আরও কত অমর কাব্য লিখে ফেলতেন। ভাগ্য ভাল যে সে সময় হোয়াটসঅ্যাপ ছিলো না নাহলে এইসব অসামান্য কাব্যসম প্রেমপত্রগুলি থেকে বঞ্চিত হতো পৃথিবী।
আমরা দেখি এক সামান্য নারী কীভাবে উত্তরণ ঘটাতে পেরেছিল এক সাধারণ কবি থেকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিরূপে, জন কিট্‌স।
কবির জীবনে প্রেম এক জাদুবাস্তব আজও পর্যন্ত।
 

ক্রমশ…

No comments:

Post a Comment

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)