বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/ছোটগল্প/২য়
বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/শারদ/১১ই আশ্বিন, ১৪৩১
শারদ
| ছোটগল্প
অশোক সরকার
পুরানা হাভেলি
"এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে আপনি সব ধরনের পোশাক পরিচ্ছদ, অ্যাটায়ার থেকে শুরু করে যে কোনো উপহার সামগ্রী কিনে, তারপর একটা সুস্বাদু লাঞ্চ সেরে নিতে পারবেন, সাথে চাইলে একটা ডাবল পেগও নিতে পারেন। আর বারমেট যদি রাজি থাকে তবে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেড়ানোর আগেই বিয়েটাও সেরে ফেলতে পারেন।"
গল্পের নামটা ভুতুড়ে
হিন্দি ছবির মতো হলেও এটা
মোটেই ভূতের গল্প নয়। তখন আমার পোস্টিং শিলিগুড়িতে।
মাঝেমধ্যে মিটিং-এর জন্য ডাক পড়ত কলকাতায়।
তখনো ট্রেনে তৎকাল টিকিটের জামানা আসেনি। রেলের
লোক ধরে, রেকমেন্ডেশন, রিকুয়েস্ট ফর্ম
ভর্তি করে, টিকিট পেলাম দার্জিলিং মেলের স্লিপার ক্লাস।
সেদিন ট্রেন লেট। শিয়ালদা ঢুকতেই সকাল সাড়ে নটা।
স্টেশনের কাছেই একটি অপরিচ্ছন্ন হোটেলে লাগেজ রেখেই ছুটলাম ডালহৌসি পাড়ায়,
হেড অফিস। এড়ানো গেল না দেরিতে পৌঁছানো।
আর যারা কর্মসূত্রে রিভিউ মিটিং অ্যাটেন্ড করেছেন,
তাদের জানা যে মিটিংয়ে
একটি মুরগি পেলে সবাই মিলে তাকেই চটকায় সারাদিন।
এটাই কর্পোরেট কালচার। সেদিনও
দিনভর চলল মিটিংয়ের নামে যথেচ্ছাচার। তারপর বিদ্ধস্ত হয়ে ফিরলাম
শিলিগুড়ি। আমার
জোনাল হেড আগেই জেনে গেছেন মিটিংএ হেনস্থা হওয়ার কথা।
প্রশংসার কথা ছড়ায় না। আর ধোলাই-এর খবর, বিস্তারিত বিবরণ সহ ঝড়ের গতিতে পৌঁছে যায় সব
জায়গায়।
আসলে সেবার ব্যাংকে গোল্ডেন হ্যান্ডসেক এলো। কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল বয়স্ক, অদক্ষ, অযোগ্য, অসুস্থদের ভার কমানো দরকার। তাই হ্যান্ডসেক করে ওনাদের বিদায় জানানোই সঠিক। কিন্তু হলো ঠিক তার উল্টোটা। যারা তখনও কর্মঠ, যোগ্যতম তারা গোল্ডেন হ্যান্ডসেকের সুযোগে খুঁজে নিল নতুন কর্মসংস্থান। আর যে বোঝা কমানোর জন্য এই উদ্যোগ, তারাই রয়ে গেলেন ব্যাংকে। আমার বিভাগের সিনিয়র দুজন অফিসার ব্যাংক ছেড়ে চলে গেলে গেছিলেন সেই সময়। আর আমার উপরেই পড়েছিল বিভাগের দায়িত্ব।
সেটাই ছিল আমার প্রথম বড় মিটিং, জোনের প্রতিনিধি হয়ে। জোনাল হেড অবশ্য মিটিং নিয়ে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেননি। শুধু জানতে চেয়েছিলেন কীভাবে কলকাতা গিয়েছিলাম আর কোথায় ছিলাম। তারপর শুধু বলেছিলেন “পরের বার থেকে ট্রেন নয়, এরোপ্লেনে যাবে আর থাকবে কোনো গ্রেট হোটেলে। তখন আর এসব খারাপ লাগবে না। দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে, চালচলনও পাল্টে যাবে। পরের বার থেকে আর স্টেশন নয়, ডিপারচার লাউঞ্জ, সিকিউরিটি চেক, অ্যারাইভেলে নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে পিক্ আপ ট্যাক্সি। সেবার থেকে কলকাতায় এলেই দি গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল হয়ে উঠল ঠিকানা। কলকাতার সবচেয়ে পুরাতন চালু হোটেল সেই ১৮৪০ থেকে। তবে কলকাতার প্রথম হোটেল নয়। সেটা ১৮৩০ সালে স্থাপিত জন স্পেনস্ হোটেল। পরে অবশ্য বন্ধ হয়ে যায়। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের শুরুটা হয়েছিল অকল্যান্ড হোটেল নামে। তারপর ১৯১৫তে গ্রেট ইস্টার্ন। তখনকার দিনে ব্রিটিশরা একে বলত “জুয়েল অফ দ্য ইস্ট”। যারা আবার লন্ডনের স্যাভয় হোটেলের বিলাসিতার সাথে পরিচিত ছিলেন তারা বলতেন “স্যাভয় অফ ইস্ট”। অনেক বিশ্ববরেণ্য বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব থেকে গেছেন এই হোটেলে। নিকিতা ক্রুশ্চেভ, নিকোলাই বুল্গানিন, এলিজাবেথ II, মার্ক টোয়েন ও আরো অনেকে। আরো একজন ছিলেন তার কথা পরে বলছি। পুরনো দিন থেকেই এই হোটেল নিয়ে চলে আসছে কত মিথ! বলা হতো যে এখানে সব কিছুই পাওয়া - এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে আপনি সব ধরনের পোশাক পরিচ্ছদ, অ্যাটায়ার থেকে শুরু করে যে কোনো উপহার সামগ্রী কিনে, তারপর একটা সুস্বাদু লাঞ্চ সেরে নিতে পারবেন, সাথে চাইলে একটা ডাবল পেগও নিতে পারেন। আর বারমেট যদি রাজি থাকে তবে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেড়ানোর আগেই বিয়েটাও সেরে ফেলতে পারেন। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর থেকে কমতে থাকে এই হোটেলের জৌলুস। অবশেষে রাজ্যসরকার হোটেলটিকে বাঁচাতে অধিগ্রহণ করে ১৯৭০ সালে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বেসরকারিকরণ হয়ে যায় ভবিতব্য, ২০০৫ সালে। তারপর নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করে এই ঐতিহ্যবাহী হেরিটেজ হোটেল “দ্য ললিত গ্রেট ইস্টার্ন কোলকাতা” নামে।
হোটেল নিয়ে এত কথা লেখার কারণ হোটেল, মোটেল ফ্লোটল - সব আমাকে টানে। এর গতিময়, বৈচিত্র্যময় দৃশ্য-অদৃশ্য নানা জানা-অজানা কথা, লুকিয়ে থাকা গল্প সব কিছুই। আর পুরাতন হেরিটেজ হলে তো ইতিহাসই কথা বলে সেখানে। সেই কবে দেখেছিলাম চৌরঙ্গী সিনেমাটা। স্যাটা বোসকে মনে পড়ে? কী অসাধারণ তার পর্যবেক্ষণ, অনুধাবন। কতরকম বিচিত্র চরিত্র, কান্ডকারখানা। এই সেদিনকার পরমব্রতের শাজাহান রেসিডেন্সিতেও কত ঘটনার সমাবেশ কিছু ব্যক্ত, কিছু-বা অব্যক্ত।
ফিরে আসি গ্রেট ইস্টার্নে। আমার সিনিয়র, বারবার বলে দিয়েছিলেন থাকতে হবে পুরানা হাভেলি রুম নাম্বার ২০১। কারণটাও বলে দিয়েছিলেন। সেই মতোই বুকিং ছিল। চেক ইন-এর সময় রিসেপশন থেকে একজন বললেন আপনার বুকিং হাভেলিতে হলেও আপনি চাইলে নতুন ব্লকে আপনার একোমোডেশন করে দিতে পারি। প্রসাদ-দার কথা মাথায় ছিল, তাই পরিবর্তনের দরকার নেই। লম্বা করিডোর দিয়ে চলার সময় লাগেজ বয় বলেছিল এই ব্লকটার একটা সুন্দর নাম আছে এডোয়ার্ডিয়ান ব্লক। আমরা পুরানা হাভেলি বলি। আর ওই দিকেরটা এলিজাবেথিয়ান ব্লক, হাভেলি। আজকাল গেস্টরা এই ব্লকগুলো কম প্রেফার করে। তবে রুমগুলো ভীষণ বড়, প্রচুর স্পেস জানালার দরজা বড় বড়। যাদের ফ্যামিলি বড় তারা এদিকটা পছন্দ করে। এসে গেছে রুম নাম্বার ২০১ বিরাট, তা ৪০০ স্কোয়ার ফিট হবে, বিশাল কিং সাইজের থেকেও বড় বিছানা, ১৬ - ১৭ ফিট উঁচু সিলিং। বাথরুম আমাদের ফ্ল্যাটের রুমের থেকেও বড়। এখানে সোফা নেই আছে আরাম কেদারা, ডিভান। সব ফার্নিচারই বার্মা টিকের ডার্ক পালিশ। বিশাল বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব স্পষ্ট। ঘরে ঘড়ঘড়ে উইন্ডো এসি, অপরিচ্ছন্ন ভারী পর্দা। তবে ওই ব্যালকনিটা খুব সুন্দর, ওপেন টেরাস। মনে হয় রাস্তার উপর চলে এসেছে।
সকালে রুপোর টি-পটে আসত বেড-টি। এক আলাদা মেজাজ, মুকুটহীন সাম্রাজ্যহীন, সম্রাট। এরপর থেকে এটাই ছিল আমার ফেভারিট রুম। রিসেপশনে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছিল কেন আমি এইরকম বেঢপ সাইজের পুরনো ফার্নিস্ট রুম পছন্দ করি? যখন একই ভাড়ায় নতুন রুম এভেলেবল আছে। আমি এড়িয়ে যেতাম উত্তরটা। সরকারি হোটেলের কর্মচারীদের আন্তরিকতায়, ঔৎসুক্যতায় খামতি ছিল, তাই ইচ্ছা করত না।
এরপর শিলিগুড়ি থেকে ট্রান্সফার হয়ে কলকাতায় চলে এলাম। কলকাতায় থেকে অফিস যাওয়া আসার পথে দেখতাম হোটেলটা, বাইরে থেকে কিন্তু ভিতরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি অনেক দিন। দীর্ঘ সময় পর যখন ইউপিতে পোস্টিং হলো আবার এলাম সেই হোটেলে। এখন ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল। চাইলাম রুম নাম্বার ২০১ পুরানা হাভেলি। রিসেপশনে লোকজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। একজন বয়স্ক লোক এগিয়ে আসেন। জিজ্ঞাসা করেন আপনি কি এডোয়ার্ডিয়ান ব্লকের কথা বলছেন? ওটা তো এখন হেরিটেজ ওয়ান, আর ওই ভিক্টোরিয়ান ব্লকটা হেরিটেজ টু, নতুন ব্লকটার নাম দেওয়া হয়েছে কন্টেম্পোরারি। দিন তিনেক ছিলাম। ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম আবার হোটেলটাকে। অনেক ঝকঝকে তকতকে হয়েছে। ইটালিয়ান মার্বেলগুলো আর নেই। বসেছে ধকঝকে গ্রানাইট। পুরনো বিশাল বার্মাটিকের ফার্নিচারগুলো বদলে গেছে আধুনিক ফার্নিচারে। আর রুপোর GEH মনোগ্রাম করা কার্টলারি, ডিক্যান্টার, টি-পট, আর্নসগুলো করিডরে, লাউঞ্জে সাজানো, হেরিটেজ স্মৃতি হয়ে। কয়েকটা রাজস্থানী ওয়াল পেইন্টিং এখনো আছে, হয়তো নতুন টাচ পড়েছে। সেই ১৮০০ সালের বিখ্যাত গ্রেট ইস্টার্ন বেকারিটা রুপান্তরিত হয়েছে ডাইনিং হলে। সেখানকার একটা ওয়ালে রং প্লাস্টার কিছুই নেই। পুরনো বেকারির স্মৃতি বহন করে চলেছে আজও। আর সেই আয়রন কেজগুলো সুন্দরভাবে ঝোলানো রয়েছে, লবির ছাদ থেকে। ওই কেজের মধ্যেই বার ডান্সাররা পারফর্ম করত। ইন্তেকাম (১৯৬৯) সিনেমাটা দেখেছেন কি? লতার গলায় “আ জানে জা…” গানের সাথে হেলেনের পারফরমেন্স! হয়তো সেরকমই কিছু পারফর্ম হতো। হয়তো বা এখান থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সেই ডান্স ডাইরেক্টর! লাউঞ্জে গিয়ে দেখতে পেলাম, এখনও রয়েছে সেই বিশাল পিয়ানোটা, রাচেল অ্যান্ড কো, মেড ইন জার্মানি। সবই বহন করে চলেছে পুরনো ঐতিহ্য। হোটেল ম্যানেজার হয়তো লক্ষ্য করেছিলেন আমাকে। জানতে চান পরের দিনের চেক আউট টাইম। ওখানকার পুরনো রীতি গেস্টদের চেক আউটের সময় কমপ্লিমেন্টারি গ্রেট ইস্টার্ন-এর কেক দেওয়া হয়। পরেরদিন অফিস থেকে ফিরতেই ম্যানেজার অনুরোধ করেন আধঘন্টা আগেই লাউঞ্জে আসতে। মুখে অবশ্য বললেন এয়ারপোর্টের রাস্তায় জ্যামের কথা। যথা সময়ে লাউঞ্জে এসে দেখি ছোট একটা জমায়েত হোটেলের স্টাফ, দু-একজন গেস্টও উপস্থিত সেখানে। ম্যানেজার আমাকে গ্রিট করেই ছোট্ট একটা ইন্ট্রোডাকশন দিলেন। তারপর আমার কাছে শুনতে চান পুরানা হাভেলি রুম নাম্বার ২০১-এর কাহিনি। এবার আর এড়িয়ে যেতে পারিনি।
এখানেই থাকতেন গ্রেগরি পেগ। হ্যাঁ, রোমান হলিডে খ্যাত হলিউড সুপারস্টার এই রুমটাতেই
থাকতেন। অড্রে হেপবার্ণ অবশ্য আসেননি কখনো। গ্রেগরি পেগ বিকেলের দিকে ঐ ব্যালকনিটায় এসে, রাস্তায়
দাঁড়ানো তাঁর ফ্যানদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়তেন। অনেকটা মন্নতের
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শাহরুখ খান যেমন করেন আজকাল, অনেকটা সেরকমই।
কয়েক পেগের পরও নিজেকে গ্রেগরি পেগ মনে করার কোন কারণ হয়নি কখনো।
তবে ঐ রুমটায় ঢুকলেই রোমান হলিডের সেই বিখ্যাত গানটা “ইয়েস্টার ডে ওয়ানস্ মোর…” নিশ্চিতভাবে গুনগুনিয়ে ওঠে।
সময় হয়ে এসেছে, কম্প্লিমেন্টারি কেকও এসে গেছে
সাথে ফুলের বোকে। ধন্যবাদ জানাই ম্যানেজারকে স্টাফদের আর ম্যানেজমেন্টকেও।
কারণ ওরা নিশ্চিত করেছে সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক পরম্পরা,
ঐতিহ্যকে ভুলে কেবল আধুনিকতাই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হতে পারেনা।
হেরিটেজ আর আধুনিকতার এক অনবদ্য মিশেল হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে কলকাতার
সবচেয়ে পুরাতন হোটেল।
সমাপ্ত
Excellent ❤❤
ReplyDeleteThank you
DeleteGood 👌👌
ReplyDeleteGood 😊
ReplyDeleteকমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। Anonymous না থাকলে লেখার ব্যাপারে আলোচনা করতে সুবিধা হয় ।🙏
Delete👏👏👏
ReplyDeleteOsadharon golpo...
ReplyDeleteকী অসামান্য বর্ণণা! এ আভিজাত্য সত্যিই কোনও হাভেলির থেকে কম নয়। চর্ম চোখে চাক্ষুষ না করলেও অধ্যয়নে সবটুকু ছবির মতো পরিস্ফুট হল।
ReplyDeleteআমাদের ভিতরে ঢোকার সৌভাগ্য হয়নি, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটল। এই ধরনের লেখা খুব ভালো লাগে।
ReplyDelete