প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

রং | প্রতিজ্ঞা

  বাতায়ন/ রং /সম্পাদকীয়/২য় বর্ষ/ ৩ ২তম সংখ্যা/ ২৯শে ফাল্গুন ,   ১৪৩১ রং | সম্পাদকীয়   প্রতিজ্ঞা "নির্ভীক একটি ফুলের মতো মেয়েকে চরম লাল...

Thursday, September 26, 2024

শারদ | পুরানা হাভেলি | অশোক সরকার

বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/১৫তম সংখ্যা/শারদ/১১ই আশ্বিন, ১৪৩১

শারদ | ছোটগল্প

অশোক সরকার

পুরানা হাভেলি


"এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে আপনি সব ধরনের পোশাক পরিচ্ছদঅ্যাটায়ার থেকে শুরু করে যে কোনো উপহার সামগ্রী কিনেতারপর একটা সুস্বাদু লাঞ্চ সেরে নিতে পারবেনসাথে চাইলে একটা ডাবল পেগও নিতে পারেন। আর বারমেট যদি রাজি থাকে তবে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেড়ানোর আগেই বিয়েটাও সেরে ফেলতে পারেন।"


গল্পের নামটা ভুতুড়ে হিন্দি ছবির মতো হলেও এটা মোটেই ভূতের গল্প নয়তখন আমার পোস্টিং শিলিগুড়িতেমাঝেমধ্যে মিটিং-এর জন্য ডাক পড়ত কলকাতায়তখনো ট্রেনে তৎকাল টিকিটের জামানা আসেনিরেলের লোক ধরে, রেকমেন্ডেশন, রিকুয়েস্ট ফর্ম ভর্তি করে, টিকিট পেলাম দার্জিলিং মেলের স্লিপার ক্লাসসেদিন ট্রেন লেটশিয়ালদা ঢুকতেই সকাল সাড়ে নটাস্টেশনের কাছেই একটি অপরিচ্ছন্ন হোটেলে লাগেজ রেখেই ছুটলাম ডালহৌসি পাড়ায়, হেড অফিসএড়ানো গেল না দেরিতে পৌঁছানোআর যারা কর্মসূত্রে রিভিউ মিটিং অ্যাটেন্ড করেছেন, তাদের জানা যে মিটিংয়ে 
একটি মুরগি পেলে সবাই মিলে তাকেই চটকায় সারাদিনএটাই কর্পোরেট কালচাসেদিনও দিনভর চলল মিটিংয়ের নামে যথেচ্ছাচারতারপর বিদ্ধস্ত হয়ে ফিরলাম শিলিগুড়িআমার  জোনাল হেড আগেই জেনে গেছেন মিটিংএ হেনস্থা হওয়ার কথাপ্রশংসার কথা ছড়ায় নাআর ধোলাই-এর খবর, বিস্তারিত বিবরণ সহ ঝড়ের গতিতে পৌঁছে যায় সব জায়গায়

আসলে সেবার ব্যাংকে গোল্ডেন হ্যান্ডসেক এলোকর্তৃপক্ষ ভেবেছিল বয়স্ক, অদক্ষ, অযোগ্য, অসুস্থদের ভার কমানো দরকারতাই হ্যান্ডসেক করে ওনাদের বিদায় জানানোই সঠিককিন্তু হলো ঠিক তার উল্টোটাযারা তখনও কর্মঠ, যোগ্যতম তারা গোল্ডেন হ্যান্ডসেকের সুযোগে খুঁজে নিল নতুন কর্মসংস্থানআর যে বোঝা কমানোর জন্য এই উদ্যোগ, তারাই রয়ে গেলেন ব্যাংকে। আমার বিভাগের সিনিয়র দুজন অফিসার ব্যাংক ছেড়ে চলে গেলে গেছিলেন সেই সময়আর আমার উপরেই পড়েছিল বিভাগের দায়িত্ব

সেটাই ছিল আমার প্রথম বড় মিটিং, জোনের প্রতিনিধি হয়েজোনাল হেড অবশ্য মিটিং নিয়ে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেননিশুধু জানতে চেয়েছিলেন কীভাবে কলকাতা গিয়েছিলাম আর কোথায় ছিলামতারপর শুধু বলেছিলেনপরের বার থেকে ট্রেন নয়, এরোপ্লেনে যাবে আর থাকবে কোনো গ্রেট হোটেলেতখন আর এসব খারাপ লাগবে নাদৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে, চালচলনও পাল্টে যাবেপরের বার থেকে আর স্টেশন নয়, ডিপারচার লাউঞ্জ, সিকিউরিটি চেক, অ্যারাইভেলে নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে পিক্ আপ ট্যাক্সিসেবার থেকে কলকাতায় এলেই দি গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল হয়ে উঠল ঠিকানাকলকাতার সবচেয়ে পুরাতন চালু হোটেল সেই ১৮৪০ থেকেতবে কলকাতার প্রথম হোটেল নয়সেটা ১৮৩০ সালে স্থাপিত জন স্পেনস্ হোটেলপরে অবশ্য বন্ধ হয়ে যায়গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের শুরুটা হয়েছিল অকল্যান্ড হোটেল নামেতারপর ১৯১৫তে গ্রেট ইস্টার্নতখনকার দিনে ব্রিটিশরা একে বলতজুয়েল অফ দ্য ইস্ট”। যারা আবার লন্ডনের স্যাভয় হোটেলের বিলাসিতার সাথে পরিচিত ছিলেন তারা বলতেনস্যাভয় অফ ইস্ট”। অনেক বিশ্ববরেণ্য বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব থেকে গেছেন এই হোটেলেনিকিতা ক্রুশ্চেভ, নিকোলাই বুল্গানিন, এলিজাবেথ II, মার্ক টোয়েন ও আরো অনেকেআরো একজন ছিলেন তার কথা পরে বলছিপুরনো দিন থেকেই এই হোটেল নিয়ে চলে আসছে কত মিথ! বলা হতো যে এখানে সব কিছুই পাওয়া - এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে আপনি সব ধরনের পোশাক পরিচ্ছদ, অ্যাটায়ার থেকে শুরু করে যে কোনো উপহার সামগ্রী কিনে, তারপর একটা সুস্বাদু লাঞ্চ সেরে নিতে পারবেন, সাথে চাইলে একটা ডাবল পেগও নিতে পারেনআর বারমেট যদি রাজি থাকে তবে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেড়ানোর আগেই বিয়েটাও সেরে ফেলতে পারেনব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর থেকে কমতে থাকে এই হোটেলের জৌলুসঅবশেষে রাজ্যসরকার হোটেলটিকে বাঁচাতে অধিগ্রহণ করে ১৯৭০ সালেকিন্তু সময়ের সাথে সাথে বেসরকারিকরণ হয়ে যায় ভবিতব্য, ২০০৫ সালেতারপর নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করে এই ঐতিহ্যবাহী হেরিটেজ হোটেলদ্য ললিত গ্রেট ইস্টার্ন কোলকাতানামে

হোটেল নিয়ে এত কথা লেখার কারণ হোটেল, মোটেল ফ্লোটল - সব আমাকে টানেএর গতিময়, বৈচিত্র্যময় দৃশ্য-অদৃশ্য নানা জানা-অজানা কথা, লুকিয়ে থাকা গল্প সব কিছুইআর পুরাতন হেরিটেজ হলে তো ইতিহাসই  কথা বলে সেখানেসেই কবে দেখেছিলাম চৌরঙ্গী সিনেমাটাস্যাটা বোসকে মনে পড়ে? কী অসাধারণ তার পর্যবেক্ষণ, অনুধাবনকতরকম বিচিত্র চরিত্র, কান্ডকারখানাএই সেদিনকার পরমব্রতের শাজাহান রেসিডেন্সিতেও কত ঘটনার সমাবেশ কিছু ব্যক্ত, কিছু-বা অব্যক্ত

ফিরে আসি গ্রেট ইস্টার্নে। আমার সিনিয়র, বারবার বলে দিয়েছিলেন থাকতে হবে পুরানা হাভেলি রুম নাম্বার ২০১কারণটাও বলে দিয়েছিলেনসেই মতোই বুকিং ছিলচেক ইন-এর সময় রিসেপশন থেকে একজন বললেন আপনার বুকিং হাভেলিতে হলেও আপনি চাইলে নতুন ব্লকে আপনার একোমোডেশন করে দিতে পারিপ্রসাদ-দার কথা মাথায় ছিল, তাই পরিবর্তনের দরকার নেলম্বা করিডোর দিয়ে চলার সময় লাগেজ বয় বলেছিল এই ব্লকটার একটা সুন্দর নাম আছে এডোয়ার্ডিয়ান ব্লকআমরা পুরানা হাভেলি বলিআর ওই দিকেরটা এলিজাবেথিয়ান ব্লক, হাভেলিআজকাল গেস্টরা এই ব্লকগুলো কম প্রেফার করেতবে রুমগুলো ভীষণ বড়,  প্রচুর স্পেস জানালার দরজা বড় বড়যাদের ফ্যামিলি বড় তারা এদিকটা পছন্দ করেএসে গেছে রুম নাম্বার ২০১ বিরাট, তা ৪০০ স্কোয়ার ফিট হবে, বিশাল কিং সাইজের থেকেও বড় বিছানা, ১৬ - ১৭ ফিট উঁচু সিলিংবাথরুম আমাদের ফ্ল্যাটের রুমের থেকেও বড়এখানে সোফা নেই আছে আরাম কেদারা, ডিভানসব ফার্নিচারবার্মা টিকের ডার্ক পালিশবিশাল বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নাতবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব স্পষ্টঘরে ঘড়ে উইন্ডো এসি, অপরিচ্ছন্ন ভারী পর্দাতবে ওই ব্যালকনিটা খুব সুন্দর, ওপেন টেরাসমনে হয় রাস্তার উপর চলে এসেছে

সকালে রুপোর টি-পটে আসত বেড-টিএক আলাদা মেজাজ, মুকুটহীন সাম্রাজ্যহীন, সম্রাটএরপর থেকে এটাই ছিল আমার ফেভারিট রুমরিসেপশনে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছিল কেন আমি এইরকম বেঢপ সাইজের পুরনো ফার্নিস্ট রুম পছন্দ করি? যখন একই ভাড়ায় নতুন রুম এভেলেবল আছেআমি এড়িয়ে যেতাম উত্তরটাসরকারি হোটেলের কর্মচারীদের আন্তরিকতায়, ঔৎসুক্যতায় খামতি ছিল, তাই ইচ্ছা করত না

এরপর শিলিগুড়ি থেকে ট্রান্সফার হয়ে কলকাতায় চলে এলাম। কলকাতায় থেকে অফিস যাওয়া আসার পথে দেখতাম হোটেলটা, বাইরে থেকে কিন্তু ভিতরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি অনেক দিনদীর্ঘ সময় পর যখন ইউপিতে পোস্টিং হলো আবার এলাম সেই হোটেলেএখন ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলচাইলাম রুম নাম্বার ২০১ পুরানা হাভেলিরিসেপশনে লোকজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করেএকজন বয়স্ক লোক এগিয়ে আসেনজিজ্ঞাসা করেন আপনি কি এডোয়ার্ডিয়ান ব্লকের কথা বলছেন? ওটা তো এখন হেরিটেজ ওয়ান, আর ওই ভিক্টোরিয়ান ব্লকটা  হেরিটেজ টু, নতুন  ব্লকটার নাম দেওয়া হয়েছে কন্টেম্পোরারিদিন তিনেক ছিলাম।‌ ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম আবার হোটেলটাকেঅনেক ঝকঝকে তকতকে হয়েছেইটালিয়ান মার্বেলগুলো আর নেই। ‌বসেছে ধকঝকে গ্রানাইটপুরনো বিশাল বার্মাটিকের ফার্নিচারগুলো বদলে গেছে আধুনিক ফার্নিচারেআর রুপোর GEH মনোগ্রাম করা কার্টলারি, ডিক্যান্টার, টি-পট, আর্নগুলো করিডরে, লাউঞ্জে সাজানো, হেরিটেজ স্মৃতি হয়েকয়েকটা রাজস্থানী ওয়াল পেইন্টিং এখনো আছে, হয়তো নতুন টাচ পড়েছেসেই ১৮০০ সালের বিখ্যাত গ্রেট ইস্টার্ন বেকারিটা রুপান্তরিত হয়েছে ডাইনিং হলেসেখানকার একটা ওয়ালে রং প্লাস্টার কিছুই নেইপুরনো বেকারির স্মৃতি বহন করে চলেছে আজওআর সেই আয়রন কেগুলো সুন্দরভাবে ঝোলানো রয়েছে, লবির ছাদ থেকেওই কেজের মধ্যেই বার ডান্সাররা পারফর্ম করতইন্তেকাম (১৯৬৯) সিনেমাটা দেখেছেন কি? লতার গলায়আ জানে জা…” গানের সাথে হেলেনের পারফরমেন্স! হয়তো সেরকমই কিছু পারফর্ম হতোহয়তো বা এখান থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সেই ডান্স ডাইরেক্টর! লাউঞ্জে গিয়ে দেখতে পেলাম, এখনও রয়েছে সেই বিশাল পিয়ানোটা, রাচেল অ্যান্ড কো, মেড ইন জার্মানিসবই বহন করে চলেছে পুরনো ঐতিহ্যহোটেল ম্যানেজার হয়তো লক্ষ্য করেছিলেন আমাকেজানতে চান পরের দিনের চেক আউট টাইমওখানকার পুরনো রীতি গেস্টদের চেক আউটের সময় কমপ্লিমেন্টারি গ্রেট ইস্টার্ন-এর কেক দেওয়া হয়পরেরদিন অফিস থেকে ফিরতেই ম্যানেজার অনুরোধ করেন আধঘন্টা আগেই লাউঞ্জে আসতেমুখে অবশ্য বললেন এয়ারপোর্টের রাস্তায় জ্যামের কথাযথা সময়ে লাউঞ্জে এসে দেখি ছোট একটা জমায়েত হোটেলের স্টাফ, দু-একজন গেস্টও উপস্থিত সেখানেম্যানেজার আমাকে গ্রিট করেই ছোট্ট একটা ইন্ট্রোডাকশন দিলেনতারপর আমার কাছে শুনতে চান পুরানা হাভেলি রুম নাম্বার ২০১-এর কাহিনি। এবার আর এড়িয়ে যেতে পারিনি। 

এখানেই থাকতেন গ্রেগরি পেগহ্যাঁ, রোমান হলিডে খ্যাত হলিউড সুপারস্টার এই রুমটাতেই থাকতেনঅড্রে হেপবার্ণ অবশ্য আসেননি কখনোগ্রেগরি পেগ বিকেলের দিকে ঐ ব্যালকনিটায় এসে, রাস্তায় দাঁড়ানো তাঁর ফ্যানদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়তেনঅনেকটা মন্নতের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শাহরুখ খান যেমন করেন আজকাল, অনেকটা সেরকমইকয়েক পেগের পরও নিজেকে গ্রেগরি পেগ মনে করার কোন কারণ হয়নি কখনোতবে ঐ রুমটায় ঢুকলেই রোমান হলিডের সেই বিখ্যাত গানটাইয়েস্টার ডে ওয়ানস্ মোর…” নিশ্চিতভাবে গুনগুনিয়ে ওঠেসময় হয়ে এসেছে, কম্প্লিমেন্টারি কেকও এসে গেছে সাথে ফুলের বোকেধন্যবাদ জানাই ম্যানেজারকে স্টাফদের আর ম্যানেজমেন্টকেওকারণ ওরা নিশ্চিত করেছে সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক পরম্পরা, ঐতিহ্যকে ভুলে কেবল আধুনিকতাই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হতে পারেনাহেরিটেজ আর আধুনিকতার এক অনবদ্য মিশেল হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে কলকাতার সবচেয়ে পুরাতন হোটেল
 

সমাপ্ত

9 comments:

  1. Replies
    1. কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। Anonymous না থাকলে লেখার ব্যাপারে আলোচনা করতে সুবিধা হয় ।🙏

      Delete
  2. PRONAB KUMAR ALPANA SEALSeptember 29, 2024 at 11:00 PM

    👏👏👏

    ReplyDelete
  3. কী অসামান্য বর্ণণা! এ আভিজাত্য সত্যিই কোনও হাভেলির থেকে কম নয়। চর্ম চোখে চাক্ষুষ না করলেও অধ্যয়নে সবটুকু ছবির মতো পরিস্ফুট হল।

    ReplyDelete
  4. আমাদের ভিতরে ঢোকার সৌভাগ্য হয়নি, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটল। এই ধরনের লেখা খুব ভালো লাগে।

    ReplyDelete

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)