বাতায়ন/দহন/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
দহন | ছোটগল্প
জনা
বন্দ্যোপাধ্যায়
অধিকার
"ঘরের ছোট জানলা দিয়ে সামান্য চাঁদের আলো এসে বিছানায় পড়ে। মীরা চোখ বুজে ঝিঁঝিঁর আওয়াজ শুনতে পায়, সেই সঙ্গে দমকা হাওয়া এসে বিছানার চাদর উথালপাতাল করে।"
মীরার আজ বিয়ের রেজিস্ট্রেশন। বয়স প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই। মুখের বলিরেখাগুলো স্পষ্ট! পাশের বাড়ির এক তরুণী মীরাকে সাজিয়ে দিয়েছে। নীল সিল্কের শাড়িতে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় মীরা। তার প্রথম স্বামী নিখিল গত হয়েছেন প্রায় পাঁচবছর। প্রাইভেট কোম্পানির কাজে তাঁর পেনশন ছিল না বললেই চলে। মীরার ছেলে মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভের কাজ নিয়ে বাংলার নানাপ্রান্তে ঘোরে, মায়ের প্রতি টান না থাকায় বাড়িতে আসে না। শেষে মীরার ছোটভাই দিদির দ্বিতীয় বিয়ের উদ্যোগ নেয়। সমাজ যে ভাবেই দেখুক, এই বয়সে যে অবলম্বন দরকার মীরা বোঝে।
অনেক বছর আগে প্রথম বিয়েতে
নিজের মায়ের দেওয়া আশীর্বাদ স্বরূপ রূপোর সিঁদুর কৌটোটা খুঁজে না পাওয়ায় মন খারাপ
হয়ে যায় মীরার। ঠাকুর ঘরের কুলুঙ্গিতে রাখা ছিল কৌটোটি। সংসারের অভাবের জন্য নিখিল হয়তো
মীরাকে না বলে ওটা বেচে দিয়েছেন— মীরা জানতেও পারেনি। বাড়িটা ভাড়া। আজকের পর ছেড়ে
দেবে মীরা! প্রায় কুড়িবছর এই ভাড়া বাড়িতে নিজের সংসার কাটিয়েছে। ঘরের রংচটা দেওয়াল, জানলার ছেঁড়া পর্দা, দু-একটি সাধারণ আসবাবের দিকে মায়াময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মীরা।
নিখিলের মৃত্যুর পর কাছেই একটি বাড়িতে বাচ্চা দেখার আয়ার কাজ নিয়েছে সে। মাস গেলে পাঁচহাজার
টাকা মাইনে। দ্বিতীয় বিয়ের শর্ত ছিল মীরা বিয়ের পর কাজ ছাড়বে না। হবু স্বামী তপন
এই শর্তে রাজি হয়েছেন। তাঁর নিজের একটি টোটো আর টালির চালের
দু-ঘরের বাড়ি আছে। তপন বিপত্নীক। একমাত্র ছেলের বউ শান্তা ঘর
দুটো দখলের জন্য প্রায়ই শ্বশুরকে কটু কথা শোনাত। শেষে পাড়ার লোকেদের পরামর্শে তপন
বিয়ে করতে রাজি হন। তপনের ভাগ্নে ও মীরার ভাই বন্ধু, তাই কথা পাকা হতে বেশি দেরি লাগে না। তপনের জমানো টাকা বেশি নেই। মীরাকে কোনো গয়না তিনি দিতে পারেননি। দুটি ভালো তাঁতের শাড়ি, নতুন ভ্যানিটি ব্যাগ ও চটি কিনে দিয়েছেন। মীরাকে তপন জিজ্ঞাসা
করেছিলেন আর কী লাগবে। মীরা শুধু একটি রূপোর সিঁদুর কৌটো চেয়েছে। তপন তাঁর ভাগ্নেকে
সঙ্গে নিয়ে সোনারূপোর দোকান থেকে কিনে এনেছেন। মীরা তপনের জন্য ভালো শার্ট-প্যান্ট কিনে রেখেছে। মীরা আর তপনের বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের পর তপন সিঁদুর
কৌটোটি মীরার হাতে তুলে দেন। মীরার মুখে হাসি দেখে তপনের ভালো লাগে। মীরার চেহারা
একটু স্থূল হলেও দোহারা তপনের পাশে মীরাকে ভালো মানিয়েছে। তপনের ভাগ্নে মোবাইলে
সেদিনের কয়েকটি ছবি তোলে।
মাসতিনেক কেটে যায়। তপনের
ছেলে, ছেলের বউ শান্তা পাশের ঘরে
থাকে। হাঁড়ি আলাদা। তবু মীরা সন্ধেবেলা কাজ থেকে ফিরে কী রান্না করে সেদিকে খেয়াল রাখে। মীরা এমন কৌশলে চলে যাতে শান্তা ঝগড়ার
কোনো ছুতো না পায়।
মীরা আর তপনের দাম্পত্য
একভাবে কেটে যাচ্ছিল। তপন একটু করে টাকা জমিয়ে পরের গ্রীষ্মে ফ্রিজ কেনার
পরিকল্পনা করেন। এতে দু-একদিনের রান্না করে রাখলে মীরার
সুবিধা হবে। মীরা বোঝে তপন তার ভালোই খেয়াল রাখেন। স্ত্রীর কী দরকার নিখিল এ ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন ছিলেন। সেবার বর্ষা দেরিতে হওয়ায় চাষিরা চিন্তায় পড়েছে। দীর্ঘ দাবদাহ চলছে। রাতে একদিন খাওয়াদাওয়ার পর হঠাৎ করেই
তপনের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। মীরা তপনের ভাগ্নেকে খবর দেয়। কিন্তু কাউকে কোন চিকিৎসার
সুযোগ না দিয়ে তপন ইহলোক ত্যাগ করেন। মীরা শোকে পাথর হয়ে যায়। তপনের বয়স হয়েছিল
মাত্র পঁয়ষট্টি। মালা চন্দন পরিয়ে নিয়ে যাবার সময় পাড়ার মেয়ে বউরা মীরার সিঁদুর
মুছে দেয়।
দু-তিনদিন পর
তপনের ছেলের বউ শান্তা গুটি গুটি পায়ে মীরার ঘরে এসে ঢোকে। মীরা একভাবে খাটে বসে
ছিল, শোক কাটেনি। শান্তাকে দেখে
বলে,
-কিছু বলবে?
শান্তা একটু হেসে মাথা দুলিয়ে
বলে,
-এই বলছিলাম যে,
তোমার
একটা রূপোর সিঁদুর কৌটো দেখেছিলাম। ওটা তো তোমার কোনো কাজে লাগবে না। আমায় দিয়ে
দাও।
-ওটাই তোমার
শ্বশুরের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন,
আমি
দিতে পারব না। কিছু মনে কোরো না।
শান্তাও ছাড়ার পাত্রী নয়, মুখ বেঁকিয়ে বলে,
-ও বাবা, বিধবা মানুষের সিঁদুর কৌটোর শখ তো মন্দ নয়!
মীরা উত্তর দেয় না। শান্তা
গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলে মীরার চোখ জলে ভরে যায়। ঘরের ছোট জানলা দিয়ে সামান্য
চাঁদের আলো এসে বিছানায় পড়ে। মীরা চোখ বুজে ঝিঁঝিঁর আওয়াজ শুনতে পায়, সেই সঙ্গে দমকা হাওয়া এসে বিছানার চাদর উথালপাতাল করে।
এইসময় তীব্র শোকের দহন, তবু মীরা জানে সিঁদুর
কৌটোর অধিকার ছাড়লে শেষে তপনের ঘরে থাকার অধিকারও চলে যাবে। বাঁচার জন্য তো
অধিকারটুকুই প্রয়োজন!
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment