ধারাবাহিক
গল্প
ডঃ নিতাই
ভট্টাচার্য
ডিভোর্স
প্রসঙ্গে হরিলাল
[৩য় পর্ব]
"বিচ্ছেদের পরের জীবনাটা সত্যিই অন্ধের হস্তি দর্শন। কেউ যন্ত্রণা ভুলে শান্তি পেয়েছে কেউ বা পুরানো দিন বুকে নিয়ে বেঁচে রয়েছে।"
পূর্বানুবৃত্তি শুরু হয়
ডিভোর্স নিয়ে লেখাপড়া, ফেসবুকের শিরায় শিরায় অনুসন্ধান।
দিন রাত। রাত দিন। ডিভোর্সের ভাল-মন্দ। বিবাহবিচ্ছেদ কেন ও তার প্রতিকার। তারপর…
মাসতুতো দিদি ডিভোর্সি। মনে আসে তার কথা। হরিলাল দেখা করে একদিন দিদির সঙ্গে চন্দননগর গিয়ে। কথা বলে একান্তে। "...ব্যাপারটা সমাজ অন্য চোখে দেখে হরিলাল। হাজার কথা ভাবে আমার মতো মহিলাদের নিয়ে। নানান
স্পেকুলেশন প্রেডিকশন চলতেই থাকে লোকের মনে। আমার বা আমার মতো যারা তাদের জীবনের বিভিন্ন কী, কেন, কীভাবে, কার সঙ্গে, এইবার কে সেই
নিয়ে আড়ালে আলোচনা তো চলেই। সে নিয়ে তো কিছু বলবার নেই। আসলে সম্পর্কে ফাটল
গভীর হলে আর চলা যায় না তখন বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে পড়ে, সেটাই
হলো আমার খেত্রে। তারপরেও সিঁথিতে সিঁদুর রেখেছি, লোকে হাসে। কী করব বল। সে তো বেঁচে আছে। লোক-মুখে
খবরটা তো পাই। সিঁদুর তো স্বামীকে ভেবেই পড়া বল। চার দেওয়ালের মধ্যে আমরা আর
থাকি না ঠিকই। আইনি ভাবে আমার স্বামী-স্ত্রী নই তাই। তবে
সেদিনের মন্ত্র উচ্চারণ, অগ্নি দেবতার উপস্থিতি, প্রজাপতি ঋষির আশীর্বাদ সেগুলি তো মিথ্যা ছিল না হরিলাল। মানুষটা কাছে নেই
এই কথাটাই মানুষটাকে ভুলতে দেয় না হরিলাল। আসলে বিচ্ছেদটাই মনে করিয়ে দেয় একদিন
একসঙ্গে হাঁটা শুরু করেছিলাম। সম্পর্কে বিচ্ছেদ না এলে হয়তো আলাদা করে মনেও রাখে না
কেউ সম্পর্কের বন্ধনের কথা। কথায় বলে না মানুষ সব মানিয়ে নেয় আসলে পরিস্থিতি
বাধ্য করে মানুষকে বদলে যেতে। বিবাহবিচ্ছেদ বড় ভয়ঙ্কর হরিলাল বড় ভয়ঙ্কর। একজন
সহস্র প্রতিশ্রুতি নিয়ে পাশে ছিল একদিন আজ আর সে নেই, সে শূন্যতা ভীষণ ভারী। বোঝানো কঠিন সবাইকে। তাই...।"
"উঠি।"
হরিলাল উঠে দাঁড়ায়। বাড়ি ফিরবে।
"আমিও
একবার স্টেশন যাব।" বলে হরিলালের দিদি।
প্লাটফর্মে এসে চুপ করে বসে
হরিলাল। ভাবনায় নানা কথা আসে। হঠাৎ টোল খায় চিন্তা। ঢাকের শব্দ আসে কানে। ডাউন
প্ল্যাটফর্মের গায়ের সঙ্গে কালী মন্দির। আজ বিপত্তরিণী ব্রত। পুজো দিয়ে প্রসাদ
পেয়ে ব্রতীরা সব লাল সুতোর ডোর বাঁধছে হাতে। আশীর্বাদী সিঁদুরে রাঙিয়ে দিচ্ছে
একে অপরের সিঁথি। এখানেও সেই আপন মানুষের মঙ্গল কামনায়...। দিদির কথা মনে আসে
হরিলালের। দিদি কি রয়েছে ব্রতীদের মধ্যে। আজও কি স্বামীর মঙ্গল কামনায়
বিপত্তরিণী মায়ের চরণ ছোঁয়া সিঁদুর কপালে তুলবে দিদি? নিশ্চয়
তুলবে। মানুষটা তো রয়েছে, সে যেখানেই থাকুক না কেন।
মোবাইল বের করে হরিলাল। নিজের
লেখাটার উপর চোখ রাখে। না, যেভাবে লিখবে বলে ভাবছিল বিষয়টা তেমন নয়। বিবাহবিচ্ছেদ
বোধহয় পলকা বিষয় নয় যা নিয়ে হরিলাল লিখতে পারে। সব বিষয় সোশ্যাল মিডিয়াতে
জেনে বা পড়ে লেখা চলে না। বাস্তব বড্ড অন্যরকম সেটা আজ প্রথম বুঝল হরিলাল। হয়তো
দিদির সঙ্গে দেখা না করলে ডিভোর্স নিয়ে কয়েক কিস্তি লেখা নামিয়ে দিতে পারত
হরিলাল। কিন্তু চোখে দেখে অনুধাবন করা আর নেটিজেনদের লেখা পড়ে ধারণা করবার মধ্যে
আশমান-জমিন ফারাক। অনেকটা অন্ধের হস্তি দর্শনের মতন। নিজের
লেখা লাইনটা পড়ে এখন নিজেই লজ্জা পায় হরিলাল। ডিভোর্স মানে "দিলকে ভ্রমর
করে পুকার..."। শব্দ কয়টি ডিলিট করে দেয় হরিলাল। রতনদার কথাটা কানে বাজে,
"বিচ্ছেদ বড় যন্ত্রণার...।" দিদির কাহিনি ভাসিয়ে নিয়ে চলে হরিলালকে, "...বিচ্ছেদটা-ই
রোজ মনে করিয়ে দেয় আমরা একদিন একসাথে ছিলাম।"
রাতে শুয়ে ভাবে হরিলাল তাহলে
ডিভোর্স ব্যাপারটা কীভাবে রিপ্রেজেন্ট করা যায়। অতনুবাবু, রতন-দা, দীনু ঘোষ, হরিলালের দিদি
সবার ভাবনা পৃথক। বিচ্ছেদের পরের জীবনাটা সত্যিই অন্ধের হস্তি দর্শন। কেউ যন্ত্রণা
ভুলে শান্তি পেয়েছে কেউ বা পুরানো দিন বুকে নিয়ে বেঁচে রয়েছে। তাহলে লেখার
বিষয়টার মূল বক্তব্য কী হওয়া উচিত? নিজেকেই
প্রশ্ন করে হরিলাল। লেখা বন্ধ থাকে কয়েকদিন, ভাবনা
প্রবহমান। অবশেষে মিলল হিসাব। ডিভোর্স নিয়ে নিজের মতামত লিখল হরিলাল। ডিভোর্স এমন
একটা ব্যবস্থা যার সবদিক এক সঙ্গে ভেবে একটি সম্পূর্ণ লেখা প্রায় অসম্ভব। বরং এর
বিভিন্ন ভাল ও মন্দ দিকগুলি পয়েন্ট করে তুলে দিলাম পাঠকের সুবিধার্থে।
বিবাহবিচ্ছেদ কাঁদায় হাসায়
ভাসায় জ্বালায়।
বিবাহবিচ্ছেদ সিঁদুর কাড়ে
সিঁদুর দানও করে।
বিবাহবিচ্ছেদ জীবন ভাঙে আবার জীবন
গড়ে।
বিবাহবিচ্ছেদ ভোলায় আবার
মনেও পড়ায়।
বিবাহবিচ্ছেদ ভাগ্য গড়ে, কেউ বা অতীত
ভেবে মরে।
বিচ্ছেদ কারো বুকে বাজে, কেউ বা নতুন
করে সাজে।
অপূর্ব! অপূর্ব! শেষ লাইনটা
লেখাটার ডেপথ ভীষণভাবেই বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেই বলে হরিলাল। এরপর থামে। মাত্র
এই কয়টা পয়েন্ট! পাঠক মহলে এই ভাবনা কি ছাপ ফেলবে আদৌ।
নিজের লেখা ছ’টা লাইন বারবার পড়ে হরিলাল। মন্দ হয়নি। বরং
দারুণ হয়েছে। এক্সেলেন্ট! এমন লেখা আগে কখনও চোখে পড়েনি।
ডিভোর্সের সবদিকই প্রায় ধরে ফেলেছে হরিলাল তাও মাত্র ছ লাইনে। হঠাৎ চিন্তা ক্লিক
করে। ইদানীং অনেকেই তিন-চার লাইন লিখে
বলে সেটা নাকি অনুগল্প। তাহলে এইটাই বা হবে না কেন? ব্যস
ভাবনার অবসান। গল্পের নামের বদল করে হরিলাল। শিরোনাম দেয় ডিভোর্স নিয়ে একটি
অনুগল্প। এইবার চিন্তা মুক্ত। সম্পূর্ণ নতুন ফরম্যাটের একটি অনুগল্প। এক্কেবারে
ভিন্ন স্বাদ। অগাধ খুশি মনে নিয়ে সম্পাদক মশাইকে লেখাটি পাঠিয়ে দেয় হরিলাল।
এইবার পাঠক মহলের প্রশংসা শোনার অপেক্ষায় দিন গোনা শুরু।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment