বাতায়ন/ডিভোর্স/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/১০ম সংখ্যা/৯ই শ্রাবণ, ১৪৩২
ডিভোর্স
| ধারাবাহিক গল্প
অরূপ কুমার
দেব
ঝরা
পাতা
[১ম পর্ব]
"দুজনে নদীর ধারে তাদের সেই পুরোনো জায়গায় গেল। গাছের নীচে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সুমিলনের পুরোনো দিনের অনেক কথা মনে পড়তে লাগল। সে বিয়ের এক বছরের মাথায় এই নদীর ধারেই বসে পৃথাকে বলেছিল"
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে না বছর চল্লিশের সুমিলন নন্দীর। আগে তাড়াহুড়ো করত, সে প্রায় পাঁচ বছর আগে। সময়টা কম নয়, ক্ষত নিরাময়ের জন্য যথেষ্ট। এখন অফিস থেকে ফেরার সময় সিঁড়ি দিয়েই নামে, লিফট ব্যবহার করে না। ইচ্ছে করেই অনেকটা সময় খরচ করে দেয়।
বাড়িতে টিভি, জিও ফাইবার ও বই ছাড়া তার আর কোনও সঙ্গী নেই। যার কারণে
বাড়ি ফেরার জন্য পরিমড়ি করে দৌড়ত সেই তো বাড়ি ছেড়ে অনেক বছর আগে চলে গেছে লেডিস
হোষ্টেলে। প্রেম ঘটিত বিয়ে বা সম্বন্ধ করে বিয়ে, যাই হোক না কেন, হৃদয় জড়িয়ে থাকে দুই
ক্ষেত্রেই। হৃদয়ের ব্যাপার নিয়ে সামাজিক,
সাংসারিক
ভুল বোঝাবুঝি পাহাড় সমান। দুটি হৃদয় অভিমানে দুদিকে সরে গেছে এমন অনেক উদাহরণ আছে।
পৃথা সেনের সাথে প্রেম পর্বে
বাড়ি ফিরে যাবার আগে সুমিলনের হৃদয় ভালবাসায় ভরে ছিল। সেই তার হাতদুটো ছেড়ে চলে
গেছে বহু দূরে তাই হৃদয় আজ দু’টুকরো। আসলে প্রেমের সেই সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়
চাওয়াপাওয়ার হিসেব নিকেষে। ধীরে ধীরে সমস্যা আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরে দুজনকেই।
অধৈর্য হয়ে পার্কের প্রেমকে বিছানায় তুলে আনার পর পৃথা ঠিক সেই ভুলটাই করে বসল।
মানুষের চাওয়ার কোনও শেষ নেই, লাগাম নেই আর লজ্জাবোধও নেই। চাওয়া শুরু হয় বিয়ে করতে চাওয়া
দিয়ে। ফ্ল্যাট বাড়ির আশপাশের বৈভব আচার-আচরণ দেখে দেখে পৃথার অস্থিরতা শুরু হলো।
শিক্ষিত মেয়ে হয়েও বুঝতে পারল না এসবের উৎস কী!
সাধারণ চাকুরিজীবীর পক্ষে এসব ঐশ্বর্য কেনার সামর্থ্য নেই। এটা এক
সামাজিক ব্যাধি। অস্থিরতা থেকে চাহিদা, না পেলে ভগ্ন হৃদয়, ব্যর্থ হয়ে যায়
প্রেম।
মূল অফিস বিল্ডিং থেকে বড়
রাস্তায় যাবার আগে গাড়ি রাখার অনেক বড় জায়গা,
তারপর
গেট। পৃথাকে অনেক বছর পর গেটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুমিলন চমকে ওঠেনি বরং বেশ
অবাক হলো।
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পৃথাকে
দেখল সুমিলন। অনেকটাই রোগা হয়েছে, দেহে চাকচিক্যের ভাব।
আগের থেকেও সুন্দরী। ডায়েটিং করে, পার্লারে যায়! অসম্ভব
কিছু নয়।
ওর চাহিদা আছে, দেহের খিদে ছাড়াও অন্য অনেক খিদে বা আকাঙ্ক্ষা আছে। যার পরিচয় বিয়ের এক বছর পার হতে না হতেই সুমিলন বুঝে
গেছিল আর সেই খিদের জন্যেই সংসার ভেঙে
গেল।
গাড়ির গ্নাস নামিয়ে মুখ বের
করে সুমিলন জিজ্ঞেস করল,
-হঠাৎ এখানে, কিছু হয়েছে!
পৃথা উত্তর দিল,
-প্রশ্ন করলে জবাব দিতে হবে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী শোনাব! না কোথাও গিয়ে বসবে।
-অফিস পাড়ায় বসার জায়গা কোথায়! যদি চাও তো আমার গাড়িতে বসে
সেই আগের জায়গায় যাওয়া যেতে পারে। অবশ্য তোমার যদি অন্য কোনও অসুবিধা না থাকে।
দুজনে নদীর ধারে তাদের সেই
পুরোনো জায়গায় গেল। গাছের নীচে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সুমিলনের পুরোনো দিনের অনেক
কথা মনে পড়তে লাগল। সে বিয়ের এক বছরের মাথায় এই নদীর ধারেই বসে পৃথাকে বলেছিল,
-জানো পৃথা, ফ্ল্যাটের ইএমআই দিয়ে
হাতে বিশেষ কিছুই তো পড়ে থাকে না।
আশ্চর্য হয়ে পৃথা বলেছিল,
-কী বলছ কী তুমি!
-কত কিছু যেমন গাড়ি,
এসি, ওয়াসিং মেশিন ইত্যাদি কিনতে ইচ্ছে করে কিন্তু কিনতে পারি
না।
-এখনই অস্থির হচ্ছো কেন! সংসারটা একটু গুছিয়ে নাও। সন্তানের
জন্যও তো কিছু সঞ্চয় করে রাখতে হবে!
-সন্তানদের মানুষ করতে,
তাদের
স্কুলে দেওয়া-নেওয়া করতে যখন তোমার সময় সত্যি কমে যাবে তখন অবশ্যই কিনে দেব। আর ঋণটাও তখন অনেকটাই শোধ হয়ে যাবে।
কথাগুলো বলে সুমিলন সেদিন
ভেবেছিল সমস্যা মিটে গেছে কিন্তু সমস্যা গভীর ক্ষতের রূপ নিল। মানুষের জীবনটাই
সমস্যার মুখোমুখি হয়ে লড়াই করা। জীবনের শুরুতেই স্কুলের পড়া কলেজ, চাকরি। শেষে বিবাহিত জীবনে অচেনা, অজানা, অদেখা সমস্যা। এই
সমস্যাগুলো সমাধানের কোনও পাঠ্যপুস্তক নেই। প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে নিজেকে যুদ্ধ
করে বেঁচে থাকা।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment