ধারাবাহিক গল্প
অরূপ কুমার
দেব
ঝরা
পাতা
[২য় পর্ব]
"আমি অনেক বড় ভুল করেছি সুমিলন। আমি আবার ফিরে যেতে চাই। চাই না এই চাকরি, চাই না অর্থ। শুধু তোমাকে চাই। আমায় ফিরিয়ে নেবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুমিলন বলল"
পূর্বানুবৃত্তি অফিস থেকে
বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে না বছর চল্লিশের সুমিলন নন্দীর। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পৃথাকে
দেখল সুমিলন। অনেকটাই রোগা হয়েছে,
দেহে
চাকচিক্যের ভাব। দুজনে নদীর ধারে তাদের সেই পুরোনো জায়গায় গেল। তারপর…
সেদিন সুমিলনের কথা শুনে
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর পৃথা আবার বলল,
-আমি ভাবছি চাকরি করব। জানি, একার রোজগারে সংসারের সব চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। বাড়তি
কিছু অর্থের সংস্থান হলে অনেকটাই স্বচ্ছলতা আসে। রাঁধুনি রেখে দেব, কাজের মেয়ে বাকি কাজ করে দেবে।
-তুমি এতে সুখী হবে! তোমার চাকরি কি ঠিক হয়ে
গেছে?
-মোটামুটি, আমি আমার সিদ্ধান্তটা
এখনও জানাইনি। সপ্তাখানেক সময় চেয়েছি,
তোমার
অনুমতি নেবার জন্য। বড় কোম্পানি, জুনিয়ার এক্সিকিউটিভ
পদ।
-প্রত্যেক মানুষের জীবন নিজের। নিজেই সে নিজের সিদ্ধান্ত
নিতে পারে। আমাদের বিয়েটা কিন্তু আমরা দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে একমত হয়ে করেছিলাম।
আমি বাধা দেবার কে!
পৃথার হতাশ চেহারা দেখে
সুমিলন তখন আরো বলতে লাগল,
-দেখো পৃখা, এই যুগেও ঘরে ঘরে একই
চিত্র। সংসারের তরি বা নৌকা বয়ে নিয়ে যায় একজন দাঁড় বেয়ে। সে জোগান দেয় সংসারের সব রসদ যে নৌকার হাল ধরে বসে আছে তার হাতে। নৌকাকে সঠিক
দিশায় নিয়ে যাবে সেই যে হাল ধরবে। সেই হাল ধরে থাকে স্ত্রী। এখন দুজনেই যদি দাঁড়
বই, হাল ছাড়া নৌকা দিশাহীন।
এইভাবে নৌকা বেশিদিন চলে না, ডুবে যায়। বাইরের কেউ
দেখাশোনা করবে, দুজনেই কিছুদিন বাদে প্রাণহীন মেশিন হয়ে
যাব। রাতে জৈবিক চাহিদা মেটাতে রসহীন,
প্রেমহীন, মেশিনের মতো কাজ করে। সুইচ অফ করে দুজনে দুপাশে মুখ করে
শুয়ে পড়ে। আর একটা সকাল, আর একদিন, মাস, বছর। এভাবে দুজনে
পাশাপাশি পাথরের মতো পড়ে থাকা যায় না। তুমি শিক্ষিতা যা বোঝার বুঝে নিও। যদি বুঝতে
না চাও এই ঘর ছেড়ে আমিই না হয় কোথাও চলে যাব। নিত্য অশান্তির চেয়ে মেসে থেকে কষ্ট
করা ভাল। কাজের লোক দিয়ে মেশিনের সংসারের আমার দরকার নেই।
এই ঘটনার কয়েকদিন পর সুমিলনের
বদলে পৃথাই ঘর ছাড়ল। নিজের জেদ বজায় রাখতে ফ্ল্যাট বাড়ি ছেড়ে লেডিস হোষ্টেলে চলে গেছিল।
জীবনের বহুমূল্য পাঁচ বছর খসে গেল তাদের দু’জনের জীবন থেকে। যে বয়সে মানুষ স্বপ্ন
দেখে, চিন্তা করে কী ভাবে সংসার
গড়ে তুলবে। ঠিক সেই অমূল্য সময়ে।
এসব পুরোনো দিনের চিন্তা আজকে
যখন সুমিলনের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তখনই পৃথা আচমকা বলে উঠল,
-কী এত ভাবছ নদীর দিকে তাকিয়ে বসে?
-ভাবার তো কোনও শেষ নেই, সীমাহীন ভাবনা। বলো কী বলতে এতদিন বাদে আমার এখানে এলে।
পৃথা সুমিলনকে জিজ্ঞেস করল,
-তুমি কি বিয়ে করেছ?
-শিক্ষিতা মেয়ের মুখে কমেডি কথা মানায় না। আমার জীবন
ট্রাজেডির।
-ডিভোর্সটা আমি তোমাকে ওই জন্যেই দিইনি সুমিলন।
-আবার একটা ফাঁদে পা বাড়াতে চাইনি বলেই কি!
পৃথা এবারে কাতর স্বরে বলল,
-আমি অনেক বড় ভুল করেছি সুমিলন। আমি আবার ফিরে যেতে চাই।
চাই না এই চাকরি, চাই না অর্থ। শুধু তোমাকে চাই। আমায় ফিরিয়ে নেবে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুমিলন
বলল,
-এখন তা আর হয় না। ফিরে আসার জন্য তুমি অনেকটা সময় খেয়ে
ফেলেছ। উজ্জ্বল, উদ্দীপ্ত সেই সময়।
আমি এখন উনচল্লিশ পেরিয়ে চল্লিশের দোরগোড়ায়। সংক্ষিপ্ত
হয়ে আসছে জীবন। নতুন করে আবার শুরু করার সময় আমাদের দুজনেরই আর হাতে নেই। এই ক’বছর
সময় পেলেই আমি নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করবার জন্য পাহাড়ের কোনও নির্জন স্থানে চলে
যেতাম। কোলাহলমুখর শহর থেকে কিছুদিনের জন্য শান্তির সন্ধানে। এভাবেই একবার হৃষীকেশে
এক আশ্রমের সন্ধান পেয়েছি। স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে চলে যাব সেখানে।
আমাদের অনাগত সন্তানের জন্য জমানো টাকা আর ফ্ল্যাট বিক্রির
টাকায় অনাথ শিশুদের জন্য এক স্থায়ী বাসস্থান বানিয়ে তাদের মধ্যেই বাকি জীবনটা কাটয়ে দেব। দুধের স্বাদ না হয় ঘোলেই মিটবে।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে
সুমিলন আবার বলতে শুরু করল,
-কী সুখ পেলে পৃথা! অর্থ পেলে, মা ডাক শুনতে পেলে কি! অসম্পূর্ণ তোমার এই জীবন। আশ্রমের লোকেদের সাহায্যে
আমি হৃষীকেশে কিছুদিন আগেই জমি চিহ্নিত করে এসেছি। আমার আর
ফেরার পথ নেই। তুমি ফিরে যাও পৃথা। পুরোনো পচে যাওয়া মাটিতে আর গাছ লাগিয়ে লাভ
নেই। তুমি নিজে যে পথ খুঁজে নিয়েছ সেখানেই ফিরে যাও। আমি আমার নতুন পথের সন্ধান
পেয়ে গেছি।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment