বাতায়ন/ডিভোর্স/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/১০ম সংখ্যা/৯ই শ্রাবণ, ১৪৩২
ডিভোর্স
| ধারাবাহিক গল্প
পারমিতা দে
(দাস)
ভেসে
যাওয়া ডিঙি
[১ম পর্ব]
"বারোভাতারি মেয়েছেলে, তোর আবার সংসার! যেই দেখলি দীনবন্ধু মিত্রের মোটা টাকা আছে অমনি লটকে গেলি। এখানে এসে নিজেকে রাজরানী ভাবতে শুরু করেছিস।"
-বের হ এখান থেকে হারামির ব্যাটা। মুরোদ নেই এক পয়সা রোজগারের তারপর আমার ঘর ভাঙতে এসেছিস। লক্ষ্মী কলপাড়ে চেঁচিয়ে উঠল হরিলালকে। হরিলাল ও বলল,
-তোর বাপ একদম
ভুল নাম দিয়েছে তোর নাম লক্ষ্মী না দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল মনসা।
লক্ষ্মী আরো রেগে গিয়ে
চিৎকার করে গালমন্দ করতে লাগল হরিকে। হরি চলে গেল খামারে। লক্ষ্মী এখন হরিকে
দেখলেই হল এক্কেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। আর হরিও ছেড়ে কথা বলে না।
কয়েক বছর আগেও এক চালের নিচে
লক্ষ্মী আর হরিলালের সংসার ছিল। ওদের ফুটফুটে দুটো ছেলেমেয়ে হেদু আর বুল্টি। এখন
হেদুর বয়স ছয় আর বুল্টির তিন। হরিলাল জীবনের প্রতি বড় উদাসীন। কিছুটা পাগলাটেও।
বড় সরল ও বিনয়ী মনের ছেলে। দীনবন্ধুর খামারে কাজ করে যে কটা টাকা পায় তার
প্রায় বেশির ভাগটা বিড়ি খেয়ে উড়িয়ে দেয়। মিনিটে মিনিটে বিড়ি ধরায়। সংসারের
অভাব আর হরির উদাসীন জীবন যাপনের জন্য লক্ষ্মী তার ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে যায়
দীনবন্ধু মন্ডলের কাছে। দীনবন্ধু মানুষটা খুবই সৎ সহজ সরল ও দয়ালু স্বভাবের। হরির
চেয়ে ঢের ভাল। প্রথম স্ত্রী কলেরায় মারা যাওয়ার পর বড় একা হয়ে গিয়েছিল
দীনবন্ধু। তার সাত কুলে আর কেউ নেই।
লক্ষ্মীকে দেখতে তেমন ভাল না।
মাজা গায়ের রং। নাক-চোখও তেমন একটা ভাল না। কোমর ছাপানো মিশ কালো কোঁচকানো চুল।
দুটো বাচ্চা হওয়ার পর শরীরটা বড্ড ঢলঢলে হয়ে গেছে। তবে মুখে একটা আলগা চটক আছে।
সুশ্রী বলা না গেলেও কুৎসিতও বলা যাবে না। লক্ষ্মী দীনবন্ধুর বাড়িতেই রান্নার কাজ
করত একসময়। সেখান থেকেই ওদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। দীনবন্ধুও
কিছু মাসের মধ্যে দুই ছেলে-মেয়ের মা লক্ষ্মীকে বিয়ে করে নেয়। হেদু আর বুল্টিকেও
সে নিজের সন্তানের মতোই ভালবাসে। হরিকেও নিজের খামারে চাষের
কাজে রেখে দিয়েছে দীনবন্ধু। হরিও নিজের অক্ষমতাকে মেনে নিয়েছে। ছেলেমেয়ে দুটোকে
দুবেলা খাবার জোগাড় করে দিতে পারত না ঠিক করে। নিজে আধপেটা খেয়ে থাকলেও
ছেলেমেয়েরা না খেয়ে থাকলে বাপ হয়ে বুকে বড় বিঁধত হরির।
তবে লক্ষীর প্রতি অদ্ভুত
বিতৃষ্ণা হরির। চিরকালই টাকাপয়সা গয়নাগাটির লোভ ছিল লক্ষ্মীর। দীনবন্ধুর স্ত্রীর
সমস্ত গয়না এখন লক্ষ্মীর দখলে। সারাক্ষণ পটের বিবি সেজে গয়নাগাটি পরে বসে থাকে।
আর হরিকে দেখলেই হরির পুরুষত্ব নিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলে।
আজও তার অন্যথা হয়নি।
দীনবন্ধু ব্যবসার কাজে শহরে গেছে। হরি দীনবন্ধুর বাড়িতে লাঙল নিতে এসেই কাল হল।
লক্ষ্মী হরিকে দেখে নানান কুকথা বলা শুরু করল। হরিও ছাড়ার পাত্র নয়। হরিও বলে,
-বারোভাতারি মেয়েছেলে, তোর আবার সংসার! যেই
দেখলি দীনবন্ধু মিত্রের মোটা টাকা আছে অমনি লটকে গেলি। এখানে এসে নিজেকে রাজরানী
ভাবতে শুরু করেছিস।
উল্টোদিকে লক্ষ্মী ছুটে এলো,
-বেরো এখান
থেকে হারহাবাতে। তোর কী রে তাতে? এত বাতেলা দিস নিজে কী করতে পেরেছিস? আর কখনো এখানে যদি তোকে আসতে দেখি মুড়ো ঝাঁটা মেরে বিদেয়
করব। এই কথা বলে রাখলুম।
হরি বেরিয়ে যাবে ঠিক সেইসময়
বুল্টি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে হরির একটা পা জড়িয়ে ধরে আদো আদো গলায় বলে,
-বাবা তুমি
কোতায় যাচ্ছ? আমিও যাব তোমার সাথে।
হরি বুল্টিকে কোলে তুলে আদর
করতে যাবে ঠিক তখনই লক্ষ্মী বুল্টির হাত ধরে টেনে উঠোন থেকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে
হাত ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে গেল। তারপর হরির মুখের সামনে দরজার শিকল তুলে দিল। আর
চিৎকার করে হরিকে শুনিয়ে বলতে লাগল,
-ফের যদি
কোনোদিন দেখেছি ওই লোকটাকে বাপ বলে ডাকতে সেদিন তোর একদিন কী
আমার একদিন। আদিখ্যেতা করে ওর কাছে ছুটে গেলে পরদিন পা ভেঙে খোঁড়া করে দেব
একেবারে।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment