ধারাবাহিক গল্প
পারমিতা দে
(দাস)
ভেসে
যাওয়া ডিঙি
[২য় পর্ব]
"লক্ষ্মী তো ঠিক কথাই বলেছে, "আমি কাপুরুষ। আমি তো কিছুই রাখতে পারিনি। না বউ না সন্তানদের। নয়তো আমার সন্তানরা অন্য কাউকে বাবা ডাকে?"
পূর্বানুবৃত্তি দীনবন্ধু কিছু
মাসের মধ্যে দুই ছেলে-মেয়ের মা লক্ষ্মীকে বিয়ে করে নেয়।
হেদু আর বুল্টিকেও সে নিজের সন্তানের মতোই ভালবাসে। হরিকেও
নিজের খামারে চাষের কাজে রেখে দিয়েছে দীনবন্ধু। হরিও নিজের অক্ষমতাকে মেনে
নিয়েছে। তারপর…
হরি মেয়ের অমন অবস্থা দেখে
দূর থেকে বলতে লাগল,
-তুই একখান
ডাইনি। পিশাচ। নরকেও ঠাঁই হবে না তোর।
খামারে কাজ করে এসে
সন্ধ্যাবেলায় হরি ঘরে চালে ডালে ফুটিয়ে কোনরকম খায়। তারপর বারান্দায় মাদুর
পেতে শোয়। একটা বিড়ি ধরিয়ে জোরে জোরে টানতে থাকে। খোলা আকাশের বুকে তারাদের
দিকে চেয়ে থেকে হরি ফিরে আসে পুরোনো দিনে। সেই ষোলো বছরের যুবতী মেয়ে লক্ষ্মীকে
ভালবেসে বিয়ে করেছিল হরিলাল। লক্ষ্মী বিয়ের পরদিন হরির হাত দুটো ধরে বলেছিল,
-সুখে দুঃখে
একসাথে এ জন্ম পার করব আমরা।
হরিও লক্ষ্মীর সুরে সুর
মিলিয়েছিল। আজ সেই লক্ষ্মীর মুখের ভাষা শুনলে গা ঘিনঘিন করে ওঠে হরির। এই মাদুরে
শুয়েই একসাথে কত রাত তারা গুণে কাটিয়ে দিত ওরা। কতবার অনটনের বুক চিরে পূর্ণিমার
চাঁদ উঠেছে। হরি আর কখনো চাঁদ দেখেনি। লক্ষ্মী এখনো দেখে। ওর আকাশে রোজই পূর্ণিমা।
লক্ষ্মী অনেক কষ্টে হাল ধরে
রেখেছিল সংসারের। ছেলেটা হওয়ার সাথে সাথেই সংসারের খরচ বেড়ে গেল। এদিকে হরির
দিনে তিন থেকে চার প্যাকেট বিড়ি না হলে চলে না। কোনোদিন কাজে যায় কোনোদিন ভজার
সাথে পড়ে থাকে মুনিয়াদের চায়ের দোকানে। মুনিয়ার সাথে ভজার বেশ ভাব ছিল। ভজার
কোনো রোজগারপাতি ছিল না। সারাদিন শুধু চষে বেড়াত এপাড়া-ওপাড়া।
মুনিয়ার সাথে ভজার প্রেমের কানাঘুষো খবর পেয়েই মুনিয়ার বাবা বাবলু ধর মুনিয়াকে
সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল পাশের গ্রামের তপেশ মালাকারের সাথে। সে
পেশায় জেলে। তারপর থেকে ভজার সাথে বেশির ভাগ সময়ে হরি খালপাড়ের মাঠে বসেই
প্যাকেট প্যাকেট বিড়ি ফুঁকত। ভজার দুঃখের দিনে সঙ্গ দিতে গিয়েই নিজের সংসারের
ডিঙি ডুবিয়ে দিল কখন হরি বুঝতে পারল না। লক্ষ্মীকে ছুঁয়ে কতবার দিব্বি করেছিল সে
আর কোনোদিন বিড়ি ছোঁবে না। হরিলাল সে দিব্বি কোনোদিনই মানতে পারেনি। বিড়ির নেশা
তার কাছে বউয়ের চেয়েও প্রিয়।
এদিকে লক্ষ্মী দীনবন্ধুর
বাড়িতে রান্নার কাজ করত। ছেলেকে ইস্কুলে ভর্তি করা। খাবার খরচ, ওষুধ-পত্র সবই বেশির ভাগ সময় লক্ষ্মী দিত। সংসারের এত খরচ!
একা পেরে উঠত না লক্ষ্মী। হরি মনে মনে খুব ভাল করেই জানে, লক্ষ্মী এমন মুখচোরা ছিল না আগে। সোনা-গয়না পরার
সাধ ছিল মেয়েটার। সে সাধ তো কত মেয়ে মানুষের থাকে। তবে চরিত্রহীন ছিল না। ওকে আজ
ওইভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। লক্ষ্মী তো ঠিক কথাই বলেছে, "আমি কাপুরুষ। আমি তো কিছুই রাখতে পারিনি। না বউ
না সন্তানদের। নয়তো আমার সন্তানরা অন্য কাউকে বাবা ডাকে?" একথা
ভাবতে ভাবতে একটা টিকটিকি ডেকে উঠল। হরির বুকে চিনচিনে ব্যথা করে। হীনমন্যতার
ব্যথা। ব্যর্থতার ব্যথা। হরি জানে সব ব্যথার ওষুধ হয় না। যতদিন জীবন আছে এভাবেই
বয়ে বেড়াতে হবে।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment