ধারাবাহিক
গল্প
ঋচা
কলঙ্ক
কেন চাঁদে
[৩য় পর্ব]
"ওদের হনিমুনে তৃতীয় ব্যক্তি, তাতে আবার নিলয়ের প্রথম প্রেম বা হয়তো একমাত্র প্রেম- একটা অদেখা, অন্ধকার ভয় যেন দুহাতে গিলে নিচ্ছে ওর শরীরটা- এত বিশুদ্ধ হাওয়াও যেন ঢুকছে না ওর ফুসফুসে...!"
পূর্বানুবৃত্তি পুরোনো ক্লান্ত
দিনের খোলস ছেড়ে একটা নতুন তাজা দিন! নিলয়ের যে ঘুম হয়নি সেটা ওর ঢুলুঢুলু চোখ আর
লম্বা লম্বা হাই বলে দিচ্ছিল। তবুও নিলয় ‘বেশ খুশি‘ ব্যাপারটা
ভাবিয়ে তুলল তিয়াসাকে, ঘুম না হলে তো নিলয়
ভীষণ বিরক্ত থাকে! তারপর…
ওদের বাসটা আবার চলতে শুরু করল, ঘন্টাখানেক পর পাহাড়ের শুরু, শুরুতেই একটা চেকপোস্ট। চেকপোস্টের বাঁ দিকে একটা ছোট নদী- দীর্ঘ সংঘর্ষের পথ পেরিয়ে সমতল ছুঁয়ে খানিক শান্তিতে বইছে। দূরের জলপ্রপাত- একদম সাদা
দুধের ধারা নেমে আসছে।
নদী, ঝর্ণাজলে সম্পৃক্ত- জুলাই
মাসের শেষ সময় যে! খাদের ঢালে ময়ূরের দল... জোড়া জোড়া ময়ূর দেখা গেল- এত
সুন্দরী প্রকৃতি দেখতে দেখতে বিভোর তিয়াসা!
সকাল সাতটায় বাস পৌঁছল
মুন্নার, সেখান থেকে অটোরিক্সায় হোটেল। ওদের অটোর
পেছনে আরও একটা অটো এসে থামল, সেই বাঙালি মেয়েটি, নিলয় মেয়েটিকে দেখিয়ে তিয়াসাকে বলল,
-বাঙালি খুঁজছিলে না,
এই নাও, আমার কলেজের
বান্ধবী রত্না সরকার। একটা ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। আমিই ওকে বললাম আমাদের হোটেলে উঠতে।
মেয়েটিও হাত জোড় করে হাসিমুখে
পরিচয় করতে উদ্যত হলে, তিয়াসা হাত জোড় করে হাসল।
নিলয়কে বলল,
-ওওওও এর সাথেই কাল কথা বলছিলে, আমাকে বললে না তো...!
'রত্না সরকার' নামটা খুব ভাল করে
মনে আছে তিয়াসার। বিয়ের আগেই নিলয় নিজের প্রথম প্রেম- রত্না সরকার-যাকে দেখানোর
জন্য মাকে কলেজে নিয়ে গিয়েছিল... কথাটা তিয়াসাকে বলেছিল।
নামটা শুনতেই তিয়াসার বুকের মধ্যে কেমন চিনচিন করে উঠল। শুনেছিল রত্না অন্যকাউকে
বিয়ে করার পরই নিলয় প্রথম বিয়েটা করেছিল।
-কী খাবে?
-তিয়াসা কী খাবে?
বেশ জোরেই কানে এলো, চমকে উঠল তিয়াসা।
-হ্যাঁ, কী?
-কী খাবে বলো, অর্ডার দিতে হবে তো। ফ্রেশ হয়ে
রত্নাকেও আমাদের রুমে চলে আসতে বলেছি। কাল ওর ইন্টারভিউ, একা একা কী করবে...
তুমি কী বলো?
-তোমার বন্ধু... আমি কী বলব...
ঘরের দুটো দেওয়াল পুরো কাচের, পর্দার আড়াল থেকে উঁকি মারছে পাহাড়। একদিকের কাচের দেওয়ালের বাইরে ঝুলন্ত ব্যালকনি, ব্যালকনি থেকে বাঁ দিকে কারমেল চার্চ, তার পাশ দিয়ে তিন-চার ধাপে ঢেউ খেলানো চা বাগানের তরঙ্গ। সেখানে সব মেঘেরা গোলমিটিং চালাচ্ছে কিছুক্ষণ তারপর
কী জানি কী দুঃখে ঝরে পড়ছে চারিদিক
ঝাপসা করে! অনবরত এই মেঘবৃষ্টির গল্পের মধ্যেই রত্না উচ্ছসিত। কথায় কথায় তিয়াসা রত্নার পরিবার সম্মন্ধে জানতে চাইলে রত্না জানাল ওর
ডিভোর্স কেস চলছে চারবছর ধরে, একটা মেয়ে আছে, রত্নার মায়ের কাছে থাকে। রত্না হোটেলে রিসেপশনিস্টের কাজ করে।
ওদের হনিমুনে তৃতীয়
ব্যক্তি, তাতে আবার নিলয়ের প্রথম
প্রেম বা হয়তো একমাত্র প্রেম- একটা অদেখা, অন্ধকার ভয় যেন দুহাতে গিলে নিচ্ছে ওর শরীরটা- এত বিশুদ্ধ হাওয়াও যেন ঢুকছে না
ওর ফুসফুসে...!
রত্নাকে সাথে নিয়েই ফ্লাওয়ার
গার্ডেন থেকে টপভিউ, প্রথম দিনের ভিউ লিস্টের সবটাই
দেখা হল, সাথে রত্নার প্রতি নিলয়ের যত্নশীল
স্বভাব- তার কিছুমাত্র যদি তিয়াসার প্রতি নিলয় দেখাত তবে বোধহয় তিয়াসাকে এত
বিপন্নতা, এত অস্থিরতা গ্রাস
করতে পারত না। প্রকৃতির প্রতিটা কণার হাতছানি তিয়াসা অনুভব করতে
চাইলেও আজ তার কোনো কিছুই ছুঁতে পারল না। যেন পাথরের চোখ
দিয়ে ছবির মতো দেখে গেল ট্রপিকাল অঞ্চলের বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ি ঝোপজঙ্গলের এলাচ, কফিগাছ... স্পাইস গার্ডেনের গোলমরিচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, কোকাকলা, রুদ্রাক্ষ গাছ। যেন
এক গোপন একাকিত্ব- কপালে লাল তিলক কেটে,
হাতে খাঁড়া নিয়ে
হানা দিয়েছে ওর ভালবাসার ঘরে। যখন নিলয় নিজে পছন্দ করে একটি ময়ূর পাখের কানের দুল কিনে রত্নাকে দিল আর
তিয়াসাকে বলল,
-তুমি কী নেবে পছন্দ করো।
সেটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে
বুঝিয়ে দিল, তিয়াসা সামাজিক একটা
বন্ধন মাত্র... ভালবাসা নয়।
তিয়াসা মনখারাপ করে পুরো সন্ধেটা ব্যালকনিতেই
বসে রইল, সাথ দিল ছায়ার মতো
বৃষ্টি, পাহাড়ে মিশে থাকা কাছের,
দূরের
ঘরগুলোর দরজা-জানালার ছোট-বড় আলো চৌখুপি। আর
কখনো কখনো তাতে কোনো মানুষের ক্ষণিক উপস্থিতি।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment