বাতায়ন/ধারাবাহিক গল্প/৩য় বর্ষ/১৪তম/মণিজিঞ্জির সান্যাল সংখ্যা/২৩শে শ্রাবণ, ১৪৩২
মণিজিঞ্জির সান্যাল সংখ্যা | ধারাবাহিক গল্প
পারমিতা
চ্যাটার্জি
শ্রাবণের ধারায় নতুন প্লাবন
[১ম পর্ব]
"মনিকা, রাই ওরা নাকি খুব লাস্যময়ী প্রাণোচ্ছল, তমালিকার মধ্যে কোন প্রাণ নেই। সে আধুনিকতার সাথে মানিয়ে নিলেও কোথায় যেন এক বিরাট ঘাটতি থেকে যায়।"
আজ ১০ বছরের বিবাহবার্ষিকী তমালিকার। খুব সাধারণ পরিবারে বড় হয়ে ওঠা তমালিকাকে একদিন ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে বিয়ে করে সৈকত। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা ব্যারিস্টার আর মা ছিলেন সাধারণ গৃহবধূ। খুব ভাল গান গাইতে
পারতেন, কিন্তু স্বামীর ব্যারিস্টারির প্রতাপে তার মায়ের গলার সুর মিলিয়ে যায়। নিজেকে বিলিয়ে দেন সংসারের সর্ব কাজের মধ্যে। আর
ছেলেকে মানুষ করে তুলতে চান নিজের আদর্শে, যাতে ছেলের মধ্যে
মানবিকতাবোধ তৈরি হয়। মানুষকে মানুষের
সম্মান দিতে বলতেন।
সৈকতের
মধ্যে দুটি শিক্ষা ধারার এক মিশ্র ভাবনা কাজ করত। কখনও মায়ের
মতন নম্র ভদ্র,
কখনও বা বাবার মতন অহংকারী ঔদ্ধত্য। তাই তমালিকা আজও বুঝে উঠতে পারে না তার
ভালবাসাকে। এমন শ্রাবণের দিনেই ঘনঘোর বৃষ্টিধারার মধ্যে তাদের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের
দুদিন পর সৈকত তাকে নিয়ে বেরিয়ে পরেছিল খোলা লেকের মাঠে। তখন লেকটা ফাঁকাই ছিল, কারণ ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সৈকত হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে বলল, “চল নামি” দুজনে
মহানন্দে ভিজতে-ভিজতে গান গেয়েছিল— আজি
ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে। বাড়ি ফিরেছিল দুজনে কাক ভেজা হয়ে। শ্বশুর তাদের দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন,
-পাগল নাকি
দুজনে, এভাবে
কেউ ভেজে নাকি?
শাশুড়ি
কিন্তু মৃদু হেসে বলেছিলেন,
-বাবান
জীবনটাকে মোড়কে মুড়ে না রেখে এভাবে উপভোগ করিস।
শ্বশুর গজগজ
করে বলতে লাগলেন,
-যত্তসব
মিডিলক্লাস মেন্টালিটি। তা তোমাদের বেড়াতে ইচ্ছে হয়েছিল বললেই পারতে আমি ভাল হোটেল
বুক করে দিতাম। দুজনে ক্যাণ্ডেললাইট ডিনার করে আসতে। এভাবে আর রাস্তায়-রাস্তায় ভিজো না। মনে রেখ এ শহরে আমার একটা সম্মান আছে।
তখন সৈকত কত
অন্যরকম ছিল, আস্তে-আস্তে বদলে বাবার
মতনই হয়ে যেতে থাকল। সেই পার্টি মদ খাওয়া সব আসতে-আসতে তাকে
গ্রাস করে ফেলল। কতদিন তাদের মধ্যে ভাল সম্পর্ক নেই অথচ
বিয়ের তারিখটা কিন্তু খুব ঘটা করে হয়, লোক দেখান। তার কিছু চরম আধুনিকা গার্লফ্রেন্ড আছে তাদের জন্যেই যেন এই বিয়ের
পার্টির আয়োজন। মনে পড়ে প্রথম বিয়ের তারিখে সৈকত তাকে নিয়ে
পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল। শুধু সে আর সৈকত আর কেউ ছিল না। রাতের বেলায় কত ফুল এনেছিল সেই ঘরে। সব তমালিকার
পছন্দের ফুল। কানে-কানে বলেছিল আজকের
রাতটা তুমি তোমার মতন করে সাজাও আঁখি। তমালিকার ডাক নাম আঁখি, সৈকত তাকে
ওই নামেই ডাকত। এখন তো কোন সম্ভাষনই
হয় না, ভাববাচ্যে কথা হয়। ছেলে নীল হবার পর তারা প্রায় দীর্ঘ চার বছর আলাদা ঘরে শোওয়া আরম্ভ করেছে। সৈকতের বক্তব্য একসাথে চারজন অত ঘেঁষাঘেঁষি
করে সে শুতে পারবে না, সারাদিন তাকে অনেক কাজ
করতে হয়। তমালিকা নিঃশব্দে মেনে নিয়েছিল তার এই বদলটা। মনে
আশা ছিল একদিন সৈকত ঠিক বদলাবে। সেই আশা নিয়ে কাটতে-কাটতে আজ প্রায় চার বছর পার করে দিল। মনিকা, রাই ওরা
নাকি খুব লাস্যময়ী প্রাণোচ্ছল, তমালিকার মধ্যে কোন প্রাণ নেই। সে আধুনিকতার সাথে মানিয়ে নিলেও কোথায় যেন এক বিরাট ঘাটতি থেকে যায়। রাই
বলেছে “সৈকতদা তোমার বউ হিসাবে তমালিকাকে জাস্ট মানা যায় না।”
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment