বাতায়ন/মাসিক/ধারাবাহিক
গল্প/৩য় বর্ষ/২১তম সংখ্যা/২৭শে ভাদ্র,
১৪৩২
ধারাবাহিক গল্প
যাদব দাস
এক
ছটাক মেঘ
[৩য় পর্ব]
"শুভ নিবিষ্ট মনে ওকে দেখছিল। অনিশা 'ধ্যেত' বলে এগিয়ে যায় কিছুটা। এগিয়ে গিয়েও ফিরে আসে সেখানে, যেখানে দাঁড়িয়ে শুভ ওর চোখে চোখ রেখে আঠা হয়ে গেছিল।"
পূর্বানুবৃত্তি আপাতত কোনও প্রয়োজনীয় কাজ নেই। আর থাকলেই বা, সেই কাজ তো আর তোর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর চেয়ে মূল্যবান নয়। কাজেই চল। তারপর…
ওরা হাঁটছিল। আপাতত ভিড় কাটিয়ে ডানদিকে একটা সংকীর্ণ রাস্তায় ওদের প্রবেশ, যে রাস্তার পোশাকি নাম লেন। ভিড় এড়াতে ছোটো-ছোট গাড়ি, মোটরবাইক সব এই রাস্তা ঘুরে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বাঁ-দিকে মোড় নিয়ে মূল রাস্তায় পুনরায় মিশে যাচ্ছে। তাই এই গলিরাস্তায় আজ গাড়ির ঢল। এখানে রোদের শাসন লঘুতর।
রাস্তার উভয়দিকে সারিবদ্ধ
গাছ। ফলে রাস্তার উপর মোলায়েম ছায়া। ওরা একমনে হাঁটছে। নীরব। একটু আগেই
কথাবৃষ্টি ওদের মেঘলা মনের আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছিল, এখন খানিক বিরতি। আবেগ যখন ঘনীভূত হয়ে মনের আকাশ ঢেকে ফেলে
তখন উন্মনা মন অনেক কথার ভিতর ডুবে গিয়ে নীরবতায় ভাষা খুঁজে পায়। ওরাও হয়তো
খুঁজে পেয়েছে সেই ভাষা। নিস্তব্ধতার ভিতরেই বুনে দিচ্ছে অজস্র কথা। হঠাৎ থমকে
দাঁড়াল শুভব্রত। ঘুরে সোজা চোখ রাখল অনিশার চোখে, যেন ছিলাচ্যুত তির দৃষ্টিতে ধারণ করেছে সে। অনিশার নতদৃষ্টি, -কী দেখছিস?
-দেখছি... জানি
না কী দেখছি।
-এটা রাস্তা, আই মিন, আমি কী বলতে চাইছি
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস।
-আমি কি এতই
বেকুব?
-আমি কি বলেছি
তাই? ক্যাফে আর কতদূর?
-চলেই এসেছি।
একটু এগিয়ে গিয়ে রাস্তার ওপারে।
শুভ নিবিষ্ট মনে ওকে দেখছিল।
অনিশা 'ধ্যেত' বলে এগিয়ে যায় কিছুটা। এগিয়ে গিয়েও ফিরে আসে সেখানে, যেখানে দাঁড়িয়ে শুভ ওর চোখে চোখ রেখে আঠা হয়ে গেছিল। শুভ
ভাবল, এভাবেই যদি ফিরে আসত অনি, ঠিক এভাবেই, যতগুলো বছর চোখের উপর
দিয়ে সেতু পেরিয়ে অজানা কোনও চরে স্থানু হয়ে বসেছে, সেই বছরগুলো সময়ের কাঁটা ঘুরিয়ে আবার যদি ফিরিয়ে আনা
যেত... অবশ্য স্বপ্ন হাওয়ায় মিশে যায় বইকি, শুভর স্বপ্নগুলোও শুকনো পাতার মতো উড়ে গিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল একদিন। সেসব
কথা মনে পড়ায় ওর ভিতরে থাকা আরেকটা শুভ যেন আচ্ছন্নতা কাটিয়ে জেগে ওঠে। নিজেকেই
প্রশ্ন করে শুভব্রত বাগচী— লোকটা
কে? মানুষ নাকি মানুষের ঊর্ধ্বে
কেউ? কী চায় সে?
একটা কষ্ট কী ভেপে ওঠে ওর মধ্যে? সে কী ডুবে যেতে
চায় হারানো মুহূর্তগুলোর শান্ত উদাসীন জলে? হয়তো প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত আজ আবার জল পেয়ে প্রাণবন্ত। শুভব্রত
চোখদুটো ছড়িয়ে দিল আকাশে। ঝলমলে রোদের মাঝখানে একদল ধূসর মেঘ একপ্রকার বিনা
নোটিসেই সমাগত, অনিশার আবির্ভাবের মতো।
অনিশা বলল,
-দাঁড়িয়ে পড়লি যে?
শুভ বলল,
-রোদটা কেমন নিভে গেল,
তাই না?
-হ্যাঁ, এমন রোদ ঝলমলে দিনে মেঘ আকাশ ঢেকে ফেলবে মেঘ, কেউ কী ভেবেছে? যে আকাশ চোখ ঝলসে
দিচ্ছিল প্রবল প্রতাপে, সেই আকাশ এখন সৌম্যকান্ত।
রাগ, ক্ষোভ সব জল হয়ে এবার নামবে।
বৃষ্টি চাইছিল অনিশা।
বৃষ্টিভেজা দুপুরে দুটো কফি আর ক্যাফের মৌতাত যদি ফিরিয়ে দেয় সেই হারানো
দিনগুলো... একটা একটা করে স্বপ্নপাখিরা উড়ে আসছে তার কাছে। অনিশা স্পর্শ করছে
ওদের পালকনরম শরীরের একটু উষ্ণতা। প্রতিটা স্পর্শে অলৌকিক সুখের অনুভুতি। বৃষ্টি
অবশ্য হয়নি। ক্ষণিকের অতিথির মতো দুদণ্ড অপেক্ষার পরে মেঘ ফিরে যায় নিজস্ব পথ
ধরে নিজভূমে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ রোদ আবার পুড়িয়ে দিচ্ছে আকাশ মাটি গাছ পথঘাট। অনিশা
রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে গেল ক্যাফের দিকে। হালকা হাওয়ার ছোঁওয়া তার
আধপাকা চুলের গুচ্ছে। প্রশস্ত আকাশের একখণ্ড গগনচুম্বী বহুতলের ফাঁক গলে ঝলসে উঠল
অনিশার চোখে। শুভ তখনও ওপারে। কোন্ ভাবনায় নিমজ্জিত। তারপরে
ধীরে ধীরে রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়াল অনিশার পাশে। অনিশা দেখল, আগের চেহারা নেই শুভর। সেই ভরাট গাল, মাথা বোঝাই চুল,
চোখমুখের
মসৃণতা গত। ওরই মধ্যে বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখে ফুটে উঠেছে অভিজ্ঞতার ছাপ।
অনিশা বলল,
-চল, ভিতরে গিয়ে বসি।
শুভব্রত বেশ অপ্রতিভ। শ্বাস
টেনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে সে। এতক্ষণ,
অন্তত
এই ক্যাফেতে হেঁটে আসার সময়টুকু, ওর মনে হচ্ছিল এত
বছরের জমা অভিমান, বেদনা আজ উজার করে
দেবে অনিশার কাছে। কিন্তু শুভব্রত ভাবতেও পারেনি একবুক উদাসীনতা ওকে কুয়াশায়-কুয়াশায়
এভাবে ঢেকে দেবে। ওর মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল,
-আসি অনি।
মধ্যবয়স পেরোনো একটা মানুষ
দ্রুত মিলিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। অনিশা অপসৃয়মান মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল
নিঃশব্দে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment