বাতায়ন/মাসিক/অন্য চোখে/৩য় বর্ষ/১৯তম সংখ্যা/১৩ই ভাদ্র, ১৪৩২
অন্য চোখে
সুদীপা
চৌধুরী
উপলব্ধি
"যেখানে পরমুখাপেক্ষী থাকতে হবে না, অন্যের দেওয়া দুঃখকষ্টগুলোর বোঝা বইতে হবে না, নিরাশ হয়ে চোখের জল ফেলতে হবে না এবং সর্বোপরি হেরে গেছি ভেবে অনুশোচনায় লিপ্ত হতে হবে না। কারণ অন্য মানুষের জন্য কিছু করতে পারার আশাটাই তখন কেবল জ্বলজ্বল করবে নিজের মনে।"
জীবনের এতটা বয়সে এসে এটাই উপলব্ধি হয়েছে যে কখনও কারও কাছেই কিচ্ছু আশা করতে নেই। কোনও পার্থিব জিনিসের কথা বলছি না, যদিও সেটির আশাও একেবারেই করা উচিত নয়। আমি বলছি মানসিক সহায়তার কথা। কখনও ভাবতে নেই যে কেউ নিজে কষ্টে আছে মানে তার সাথে অন্যান্য মানুষেরাও কষ্টে থাকবে কিংবা সে নিজে আনন্দে আছে মানে তাকে দেখাদেখি অন্য মানুষেরাও তার আনন্দটা উপভোগ করবে।
কিন্তু জীবনে নিজেকে কারও আশার প্রদীপ
করা উচিত। কখনওই নিজে অন্য কারও আশায়
বা কিছুর আশায় যে কোনও ছোট-বড়
ব্যাপারে জীবন অতিবাহিত করা উচিত নয়। এটা করতে গেলে কষ্ট নিজের বাড়ে বই কমে না।
কারণ আমার এক্সপেক্টেশনটা হয়তো তার ইচ্ছে মতো নাও হতে পারে
সে আমার মতো কাজ নাও করতে পারে তখন কষ্টটা আমারই হবে। আমি হয়তো একটা মানুষকে
যেভাবে ভাবছি আসলে মানুষটা সেরকম নয় তাই আমার আশা পূরণ করার দায়ও তার নেই, কিন্তু আমি মনে-মনে অনেক কিছুই আশা করে বসে থাকলাম আখেরে
সেটা পেলাম না তখন কষ্টটা আমার নিজেরই হবে। মনে হবে সে আমাকে বুঝি ইনসাল্ট করল বা
সে আমাকে পাত্তা দিল না কিন্তু আসলে সেরকম কিছুই নয় আমিই
অনেক বেশি কিছু আশা করে বসেছিলাম।
তাই নিজেকে কষ্ট থেকে বিরত
রাখতে আশা পরিত্যাগ করা অতি আবশ্যক। আমরা যেমন ছোটবেলায় আমাদের মা-বাবারা বা আমরা
আমাদের সন্তানের কাছে অনেক কিছু আশা করে থাকি। তারা বড় হয়ে আমাদের ইচ্ছা মতো
চাকরি করবে বা আমাদের মনের মতো করে তাদের জীবন নির্বাহ করবে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা হয় না। তখন আমরা ভাবি ছেলেমেয়েরা আমাদের কথা শুনল না বা
আমরা ঠিকভাবে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে পারলাম না আবার অপর পক্ষে এ-ও ভাবা হয় মা-বাবা খুব বেশি কিছু আমাদের কাছ থেকে চাইছে যেটা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব
নয় বা আমাদের মন সেই কাজে উৎসাহ দেয় না। এই ভুল বোঝাবুঝির দরুণ এই অত্যধিক আশার
কারণে জীবনে সৃষ্টি হয় সমস্যা,
সৃষ্টি
হয় মনোমালিন্য, কথা কাটাকাটি এবং
অবশেষে সম্পর্কের বিচ্ছেদ। প্রত্যেক মানুষের তার জীবনকে নিজের পথে চালানোর অধিকার
রয়েছে। সেক্ষেত্রে কারও ক্ষতি না করে এবং সর্বোপরি নিজের ক্ষতি না করে প্রত্যেক
মানুষই তার নিজের স্বপ্ন দেখার অধিকার নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। কেউ বিপথে যায় কেউ
সঠিক পথ বেছে নেয় কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই একটা মানুষ সবার কথা শুনলেও শেষে গিয়ে
তার নিজের মতামতটাই তার জীবনে শিরোধার্য করে নেয়। খুব জোর করে যদি কাউকে কোন কাজ
করানো হয় এবং ফলত তার জন্য যদি কোন ক্ষতি হয় তখন আপশোশ ছাড়া অনুশোচনা ছাড়া এবং সারাটাজীবন গ্লানির পথ বেছে নেওয়া ছাড়া কিছুই
করার থাকে না। মানুষকে আশাও করতে হয় তাই একটা সীমার মধ্যে তার নিজের কতটা ক্ষমতা
সে অপরকে কতটা দিতে পারবে এটা তার সর্বদা মনে রাখা উচিত। আবার সামনের মানুষটির
কাছে সীমার বাইরে গিয়ে কিছু আশা করা একেবারেই ভুল।
হয়তো মনে-মনে এমন আশাও
করে রাখা হলো যে উলটোদিকের মানুষটা তার সব কথা শুনতে বাধ্য
সে যা বলবে তাই করবে। হয়তো সেটা করেও কিন্তু এমন একদিন এলো যে ওই উলটোদিকের মানুষটা যে সব কথা শুনত সে কোন একটি কথা
নিজের মতানুসারে করল আর তাই নিয়ে শুরু হলো বিভিন্ন অশান্তি, ঝামেলা। পারিবারিক ঘটনা তখন
আর পরিবারের মধ্যে সীমিত থাকে না বাড়তে-বাড়তে তা সমাজেও প্রভাব ফেলে। কিন্তু কারণ
খুব ছোট্ট যে নিজের আশা মতো বা তার নিজের ইচ্ছে মতো ওই মানুষটি তার কাজটি করেনি, এক্ষেত্রে নিজেকে যদি একটু সংযত করা যায়, নিজেকে যদি বোঝানো যায় তাহলে অহেতুক অশান্তি এড়িয়ে যাওয়া
যায়। মা অর্থাৎ মা সারদা এক স্থানে বলেছেন, অন্যের কাছে কী নিজের মা-বাপ-ভাইয়ের
কাছেও কিছু আশা করতে নেই। তোমার যতটুকু ক্ষমতা তাই দিয়ে তুমি অন্যের ভাল করার
চেষ্টা করো। কিন্তু কেউ তোমার জন্য কী করল না করল তা নিয়ে
মন খারাপ করে বসে থেকো না, এতে অপর দিকের
মানুষের কোন লাভ বা ক্ষতি হয় না সে তার মতোই থাকে। তাই কাউকে নিজের মনের মতো করে
বদলানো বা নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী চালানোর চেষ্টা খুবই মূর্খামি। কারণ প্রত্যেকটি
মানুষ আলাদা প্রত্যেকটি মানুষের চিন্তাভাবনা মতামত রুচি সব কিছুই আলাদা হয় তাই
নিজের মনের মতো কখনোই কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু সমাজে থাকতে গেলে একা-একা থাকা যায় না, তাই নিজে কিছুটা স্যাক্রিফাইস করে নিজের কিছুটা দিয়ে
অন্যের কিছুটা নিয়েই সংসার গড়ে ওঠে। ভালমন্দ উভয় ক্ষেত্রেই থাকে কিন্তু
আমি নিজেই শুধু ভাল আর বাকিরা খারাপ বা আমার নিজেরটাই ঠিক বাকিদেরটা ভুল এই ধারণা
কেবলমাত্র অশান্তির, অহংকারের, ইগোর
জন্ম দেয়। আর এই ধারণাগুলোর জন্যই অনেক সম্পর্ক খুব সহজে ভেঙে যায় কারণ হয়তো
তুচ্ছ থাকে কিন্তু শুধুমাত্র লড়াইয়ে জিততে হবে বলেই অনেকে সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে
আসে। সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখাটাই জেতা ভেঙে বেরিয়ে আসাটা
কিন্তু হার মাত্র। যে কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রেই কথাটি
প্রযোজ্য। তবে সমাজে সবচেয়ে বেশি যেটা প্রচলিত, ডিভোর্স
সেক্ষেত্রে একটি সম্পর্ক একটি দাম্পত্য সম্পর্ক সারাজীবন টিকে থাকাটা কিন্তু জীবনে
জিতে যাওয়ারই প্রকাশ। ভাইবোনের সম্পর্ক, শাশুড়ি-বৌমার সম্পর্ক, ভাই-ভাইয়ের
সম্পর্ক, ছেলে এবং পিতার
সম্পর্ক, মা-মেয়ের
সম্পর্ক এবং অবশ্যই আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক কিংবা পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা সমাজের
যে কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখাটাই
জীবনে প্রাপ্তি। যে কোনও কিছুই খুব সহজে ভেঙে ফেলা যায় টিকিয়ে রাখাটাই ক্রেডিটের। আর যে কোনও
সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে অতিরিক্ত আশা কিংবা মনের মতো করে অন্যকে বিবেচনা করা
ভুল। আর এই কারণেই ভুল বোঝাবুঝিরও সূত্রপাত হয়। একটা সংসারে বিভিন্ন মনের মানুষ
থাকে তাই একে অপরের সুখ-দুঃখগুলো কিংবা চাওয়া-পাওয়াগুলো যদি স্বচ্ছভাবে স্পষ্টভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে নেওয়া
যায় তাহলে অনেক ঝামেলা সরিয়ে রাখা যায়। হয়তো কারও ইচ্ছে
হল যে আজকে রান্না করব না ভাল লাগছে না বর ঠিক বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসবে, কিন্তু বেচারা হাজব্যান্ড হয়তো নানান কাজ সেরে ক্লান্ত
হয়ে ঘরে এসেছে স্ত্রীর হাতের রান্না খাবে বলে, এক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি ঘটবে, স্বাভাবিকভাবে ঝামেলা হবে, তারপরেও যদি স্ত্রী
জোর গলায় বলে না সে ঠিক কাজ করেছে একদিন তো তার মনের মতো করে সংসার চলতেই পারে, সেক্ষেত্রে কিন্তু সে ভুল, এই ভুলটা স্বীকার করেই তাকে এগিয়ে যেতে হবে। তবে স্বামী তো বুঝল তার স্ত্রীর
মনের কথা। হয়তো কোন একদিন সেই স্বামীর উচিত তার স্ত্রীকে রান্নার থেকে ছুটি দিয়ে
বাইরে একসাথে গিয়ে খেয়ে আসা,
ঘুরে
আসা। কিন্তু দুজনেই যদি দুজনের জেদে আটকে থাকে, বা স্ত্রী যদি যে আশা করেছিল সেটাতেই আটকে থাকে
তাহলে বন্ধন আলগা হতে বেশি সময় লাগবে না।
তাই অন্য মানুষের আশার আলো
হয়ে নিজেকে জ্বালিয়ে রাখা আর নিজের মনে অন্যের কাছে কিছু আশা করে বসে থাকার
মধ্যে প্রথমটাকে বেছে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ প্রথম কাজটা করলে অন্য
মানুষের সাথে-সাথে নিজেও অনেক আনন্দের এবং শান্তির স্পর্শ পাওয়া সম্ভব এবং পরেরটিতে
আশানুরূপ ফল না হলে শুধু কষ্টই পাওয়া যাবে, আর কিছুই নয়। তাই আশা করা উচিত যে আমি নিজে কারও ভাল কাজের
কারণ হব, কারও মানসিক
শান্তির কারণ হব, কাউকে মানসিক সুখ দেব
কিংবা কারও অসহায় অবস্থায় সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেব, এই আশাগুলোকে ত্বরান্বিত করতে প্রত্যেকটি মুহূর্তে নিজেকে
উৎসাহী করব নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে যাব,
আর তখন
আর অন্য কারও কাছ থেকে কোনও কিছু পাওয়ার আশায় সময় অযথা অতিবাহিত হবে না। নিজের আশাগুলোকেই ঠিক পথে নিয়ে যেতে সময়ের সাথে
এগিয়ে যাওয়াই জীবনের সঠিক পথ। যেখানে পরমুখাপেক্ষী থাকতে
হবে না, অন্যের দেওয়া দুঃখকষ্টগুলোর
বোঝা বইতে হবে না, নিরাশ হয়ে চোখের জল
ফেলতে হবে না এবং সর্বোপরি হেরে গেছি ভেবে অনুশোচনায় লিপ্ত হতে হবে না। কারণ অন্য
মানুষের জন্য কিছু করতে পারার আশাটাই তখন কেবল জ্বলজ্বল করবে নিজের মনে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment