বাতায়ন/মাসিক/ধারাবাহিক
গল্প/৩য় বর্ষ/২০তম সংখ্যা/২০শে ভাদ্র,
১৪৩২
ধারাবাহিক গল্প
যাদব দাস
এক
ছটাক মেঘ
[২য় পর্ব]
"কাজেই বিয়ে নামক হাঙ্গামা তখন অনাবশ্যক। হয়তো তখন কোনও এক ভিড়ের দঙ্গলে আবার তোর সঙ্গে দেখা। আমরা উভয়ে উভয়কে বলছি বিয়েটা না হয়ে ভালই হয়েছে বুঝলি।"
পূর্বানুবৃত্তি ও চোখদুটো
মেলে দেয় অনিশার চোখে। যেন পূর্ণিমা রাতের শান্ত-স্নিগ্ধ জলের উপর জ্যোৎস্না পল্লবিত চাঁদের দৃষ্টিদান। অনিশা লজ্জায় চোখ
সরিয়ে নিল। তারপর…
ভিড় এখনও কাটেনি। রাস্তায় ছড়িয়েছিটিয়ে জটলা। মুখে-মুখে যে কথা উড়ে বেড়াচ্ছিল হাওয়ায়। তার সূত্র ধরে মোটামুটি যা জানা গেছে তা হল, পথদুর্ঘটনায় দুজন গুরুতর আহত এবং তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘটনায় জড়িত গাড়িকে আটকে মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে পথ আটকে। পুলিশ বিষয়টা মিটিয়ে অবরোধ তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা নাছোড়বান্দা যে একটা ব্যবস্থা এই মুহূর্তে না নিলে তারা সরবে না। কাজেই এই সমস্যা সহজে মেটার নয়। হইচই, দফায়-দফায় আলোচনা। এর মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলার তৃপ্তি নেই। তাই অনিশা বলল,
-চল, একটু ফাঁকা জায়গায়
দাঁড়াই। ব্যস্ততা নেই তো তোর?
-ব্যস্ততা? না, আপাতত কোনও প্রয়োজনীয়
কাজ নেই। আর থাকলেই বা, সেই কাজ তো আর তোর
সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর চেয়ে মূল্যবান নয়। কাজেই চল। সামনেই একটা ক্যাফে মতো, তেমন কিছু না
ওই একটু
বসার জায়গা, একটু কফি আর মুখরোচক কিছু। তার
সঙ্গে অনেকগুলো বছরের জমা হওয়া কথা বেশ কয়েকমিনিটে
সেরে নেওয়ার সুযোগ। আবার কবে
দেখা হবে, আদৌ কি হবে, কতদিন আমরা আর এই গোলকের মায়াজাদুর ভিতর আটকে থাকতে পারব, কে জানে? শহরটা তখন হয়তো আরও-আরও জটিল, আরও-আরও মাথা আর গাড়ির গিজগিজে ভিড়ে স্তব্ধ, কোথাও দাঁড়াবার মতো এক চিলতে জায়গা নেই, আমাদের সংখ্যা বাড়তে-বাড়তে এমন জায়গায় হয়তো পৌঁছছে যে সরকার
বাধ্য হয়ে সন্তানগ্রহণ আইনবিরুদ্ধ এই মর্মে বিল আনতে চলেছে পার্লামেন্টে। কাজেই
বিয়ে নামক হাঙ্গামা তখন অনাবশ্যক। হয়তো তখন কোনও এক ভিড়ের
দঙ্গলে আবার তোর সঙ্গে দেখা। আমরা উভয়ে উভয়কে বলছি বিয়েটা না হয়ে ভালই হয়েছে বুঝলি।
অনিশা হাসল,
-এত কথা কোথায় খুঁজে পাস?
গা পোড়ানো গরম। যদিও মিছিল
করা স্কাইস্ক্র্যাপারের দাপটে আকাশের সঙ্কুচিত এখানে তবুও তার ফাঁক গলে গলিত রূপার
মতো ছড়ানো-ছিটানো রোদ। দু-একটা পুরনো গাছ ছাড়া এই চত্বরে
গাছের বড় অভাব। বারোটা বাজতে দেরি নেই। কাজেই রোদ লম্ব রেখায় পতিত। এই সময়
বৃষ্টি না হোক একটু মেঘের দেখা মিললে তাৎক্ষণিক আরাম পাওয়া যায়। কিন্তু হাওয়া
দপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী কয়েকদিন উষ্ণপ্রবাহের প্রবল সম্ভবনা। শুভব্রত ও অনিশা
সেই আঁচে পুড়ছে। গেঞ্জি ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে আটকে। অনিশা শাড়িতে। গরমে শরীর
ভেজা। তবু অস্বস্তি বিষিয়ে ওঠেনি একপ্রকার দৈবযোগে। বহু
বছরের পরে দুজনের সাক্ষাতে। অনিশা যে ভিড় ঠেলে বারবার এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা
করছিল তার কারণটা আর কিছু নয়,
তীব্র গরম
থেকে রক্ষা পাওয়ার মরিয়া প্রয়াস। হয়তো বুঝতে পারছিল অন্যের বিরক্তি উৎপাদন
করছে সে, কিন্তু একপ্রকার নিরুপায়
হয়েই তার বারবার এমন করা। দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। যাক এখন আর ওসব নিয়ে মাথা
ঘামায় না অনিশা, হালকা নিঃশ্বাস ফেলে
বলে,
-ক্যাফে না কোথায় যাবি বলছিলি?
-হ্যাঁ। চল।
গিয়ে একটু বসি। আবার কবে দেখা হবে,
হয়তো
হবেই না।
অনিশা বলল,
-তোর নম্বরটা দিবি। দেখা না হোক যোগাযোগ থাকবে।
-দেখা তো হবেই।
কারণটা তো তুই নিজেই বলেছিস।
-কী কারণ?
-ওই যে পৃথিবী
গোল।
-না, ঠিক তা নয় অনি। পৃথিবী গোল হোক আর না হোক, রাস্তা ঘুরে এক বিন্দুতে মিশুক বা না মিশুক, দেখা হওয়া স্বাভাবিক। আসলে পৃথিবীর তুলনায় আমাদের সীমানা, ঠিক সীমানা বলব না,
গণ্ডি
অনেক অনেক ছোট। পৃথিবী কেন, আমাদের দেশ বা
রাজ্যের মাপেও আমাদের যাত্রাপথের পরিধি অনেক ক্ষুদ্র। পঞ্চাশ, একশো, দুশো বড়জোর পাঁচশো
কিলোমিটার। তার থেকে বেশি আমাদের মতো ছাপোষা মানুষ কী আর যেতে পারে?
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment