ধারাবাহিক গল্প
ডঃ নিতাই
ভট্টাচার্য
শ্রাবণের
দিনগুলি
[২য় পর্ব]
"স্বামীর ঘর করতে পারেনি সুখী। কপালের সিঁদুরটুকু নিয়ে বিয়ের এক মাসের মধ্যে ফিরে এসেছে বাপের ঘরে। ভাগ্নির এমন যন্ত্রণার দিনে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে চরণ।"
পূর্বানুবৃত্তি গিন্নিমা যখন চরণ মাঝিকে শুনিয়ে কথাগুলো বলে
মহিমবাবুর বাড়িতে সেইসময় নিধু ছিল। গিন্নি-মায়ের কথা শুনে
কাজের অছিলায় সবার সামনে থেকে সরে গিয়েছিল নিধু। সুখীর বিয়ের কথা ভেবে সেদিন
কষ্ট পেয়েছিল খুব। তারপর…
কিছুটা রাগ করেই কথাটা বলেছিল গিন্নিমা। কথাটা ঠিকই বলেছিল মহিমবাবুর স্ত্রী। সুখী অনেকের মধ্যে অন্যরকম। ছেলেবেলা থেকে অন্যরকম ভাবে বুকে নিয়ে বড় হয়েছে সুখী। হোক না মাঝিদের ঘর, ছোট থেকে গ্রামের কপিল দাসের পালাগান শুনে এসেছে সুখী। পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের অনেক কাহিনি তার জানা।
-রামায়ণ মহাভারতের কাহিনি নিয়ে গান বাঁধতে পারে
সুখী। সে-কি অত সহজ কাজ! কী সুন্দর সুর করে গায়। ওর পছন্দ-অপছন্দের দাম দিও
চরণ।
বলেছিল
গিন্নিমা। অত কিছু দেখার সময় ছিল না সুখীর বাপের।
পাত্র পুরুলিয়ার দিকে এক পেপার মিলে কাজ করে। সেখানেই থাকে। জমিজমাও আছে সামান্য, মেয়ের মোটা
ভাত কাপড়ের অভাব হবে না। সেই ভেবেই...।
স্বামীর ঘর
করতে পারেনি সুখী। কপালের সিঁদুরটুকু নিয়ে বিয়ের এক মাসের মধ্যে ফিরে এসেছে
বাপের ঘরে। ভাগ্নির এমন যন্ত্রণার দিনে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে চরণ।
-বড় ভুল
হয়ে গেল নিধু!
চরণ মাঝির
গলায় আপশোশের সুর।
-কপাল! কী করবে বল। আমি উঠি, ফিরতি বাস ধরতে হবে। নয়তো বাড়ি
পৌঁছাতে রাত হবে। গিন্নি-মায়ের শরীর ভাল নেই।
বলে সামনে
পা ফেলতে চায় নিধু। মহিম বাবুর স্ত্রীর বাতের রোগ। ইদানীং ব্যথা বেড়েছে ভীষণ। রাতদিন হাঁটু আর কোমরের ব্যথায়
কাবু হয়ে ছটফট করে। বর্ধমানের ডাক্তার দেখেছে। ওষুধ খেয়ে
লাভ হয়নি কিছু। বাবু কীভাবে যেন খবর পেয়েছে ইন্দাস বাজারে
এক কবরেজ আছে,
সে নাকি বাতের ওষুধ দেয়। আজ ভোর থাকতেই বাঁকুড়ার বাস ধরেছিল নিধু।
গিন্নিমায়ের জন্য ওষুধপত্র নিয়ে ইন্দাস বাজারে এসে ফিরতি বাসের জন্য অপেক্ষা
করছিল। সেইসময় চরণ মাঝির সঙ্গে দেখা হয়। কথায়-কথায় সুখীর
প্রসঙ্গ আসে। নিজের মনের যন্ত্রণার কথা বলে চরণ। এক অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সামনে
পড়ে নিধু। সুখীর কথা মনে করে ভিতরে-ভিতরে আজও একবার বেসামাল
হয়ে ওঠে সে। বাস ধরবার প্রসঙ্গ তুলে চরণকে এড়িয়ে যেতে চায়। সুখীর কথা নতুন করে
শুনে যন্ত্রণার সুগভীর আবর্তে নিজেকে ফেলতে চায় না নিধু। সুখীকে সে ভালবাসে, ভীষণ ভালবাসে। তবে সেই ভালবাসা নিধুর বুকের মধ্যেই বেঁচে আছে। সুখীর অন্যত্র
বিবাহ হয়ে যাওয়ায় অফুরান কষ্ট পায় নিধু। আজও নিরালায় এই বছর শ্রাবণের
দিনগুলির কথা ভেবে অবশ মনে বসে থাকে নিধু। সুখী এসেছিল
শ্রাবণে। দিন পনেরো ছিল মহিমবাবুর বাড়ি। প্রথম-প্রথম সুখীর
কাজকর্ম দেখে বিরক্ত হত নিধু। সুখীও তেমনই, ইচ্ছে করে মেজাজ বিগড়ে দিত নিধুর।
বর্ষার বৃষ্টিতে সবাই যখন জমিতে কাজে ব্যস্ত সুখীর তখন অন্য চেহারা। কাদা জমিতে
দাঁড়িয়ে গান গাইত। নিধু সর্দার থাকতে কাজে ফাঁকি! নিধু তেড়ে যেত সুখীর দিকে।
সুখী বলত,
-বেশ করেছি।
কাজও হবে গানও গাইব যা পার করে নিও নিধুবাবু।
সুখীর এমন
উত্তর শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতে নিধু। সুখী বলত,
-তুমি কেমন মানুষ! শুকনো কাঠ এক্কেবারে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment