বাতায়ন/শারদ/প্রবন্ধ/৩য় বর্ষ/২২তম সংখ্যা/১লা আশ্বিন, ১৪৩২
শারদ | প্রবন্ধ
হিমাদ্রি
শেখর দাস
হারমোনিয়াম— স্মৃতি, সংকট, ভবিষ্যৎ
"একদিন মান্না দে দুপুরে এসেছিলেন হারমোনিয়াম দেখতে। তখন লোডশেডিং। আমাদের জেনারেটর নেই। কিন্তু তাতে তাঁর কোনও হুঁশই নেই! একটা হারমোনিয়াম টেনে, ধরলেন নানা রাগরাগিণী।"
পুজো মানে পুজোর গান, জলসা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংগীত শিল্পীদের প্রধান বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়াম। হারমোনিয়ামের অনেক স্মৃতি রয়েছে, কিন্তু এই শিল্প আজ সংকটে পড়েছে। হারমোনিয়াম দেখতে একটি বাক্সের মতো। বেলোর সাহায্যে ভেতরে বায়ু চালিয়ে যন্ত্রটি বাজাতে হয়। এতে একটি রিডবোর্ড থাকে এবং ধাতব রিডগুলি বোর্ডে সপ্তকের অন্তর্গত স্বরস্থান অনুযায়ী ক্রমোচ্চ পদ্ধতিতে সাজানো থাকে। বেলোর সাহায্যে চালিত বায়ু ভেতরে গিয়ে রিডে আঘাত করে এবং তা থেকে ধ্বনি সৃষ্টি হয়। রিডগুলির উপরে থাকে সাদা ও কালো রংয়ের পর্দা। সাদা পর্দাগুলি সাধারণত শুদ্ধ স্বর এবং কালোগুলি কোমল স্বর বোঝায়। তবে স্কেল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য নয়।
হারমোনিয়াম প্রথম অবস্থায় Diatonic scale-এ তৈরি করে পাশ্চাত্যে
ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এই যন্ত্রের চাবিগুলি পরিবর্তনের কোনো সুযোগ ছিল না বলে
নির্দিষ্ট চাবিতে সুর মেলাতে অসুবিধা হতো। এতে শিল্পীর পক্ষে ভিন্ন পর্দায় সংগীত পরিবেশন
করা সম্ভব হতো না। পরে এই অসুবিধা দূর করার জন্য ডায়াটোনিক স্কেল পরিবর্তন করে
যন্ত্রটিকে সমান স্বরান্তর (equally
tempered scale)-এ রূপান্তরিত করা হয়। ফলে যে-কোনো চাবিকে ইচ্ছেমতো ‘সা’ করে সংগীত পরিবেশন করা সহজ হয়ে যায়।
হারমোনিয়ামের চাবিগুলি একটি
নির্দিষ্ট স্কেলে বাঁধা থাকায় সংগীত পরিবেশনের সময় নতুন করে সুর বাঁধতে
হয় না। এতে হারমোনিয়ামে কণ্ঠানুশীলন সহজ হয় এবং সম্ভবত এ
কারণেই হারমোনিয়াম ভারত ও বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে এ দেশের কণ্ঠসংগীতে হারমোনিয়াম একটি অপরিহার্য ও বহুল ব্যবহৃত যন্ত্র।
হারমোনিয়াম বিদেশি বাদ্যযন্ত্র। উদ্ভব পাশ্চাত্যে হলেও
কালক্রমে যন্ত্রটি প্রাচ্যের যন্ত্রতালিকায় বিশেষ স্থান করে নেয়। ১৮৪২ সালে
প্যারিসের আলেকজান্ডার ডোরিয়ান এটি আবিষ্কার করেন বলে জানা যায়। এ বাদ্যযন্ত্রটি
‘ক্যাবিনেট অর্গ্যান’ নামেও পরিচিত।
ভারতে বিভিন্ন ধরণের
হারমোনিয়াম ব্যবহৃত হয়, যথা- কপলার
হারমোনিয়াম, বক্স হারমোনিয়াম, স্কেল চেঞ্জ হারমোনিয়াম, সিঙ্গল বেলো হারমোনিয়াম, ডবল বেলো হারমোনিয়াম
ও সাতপাট বা ইংলিশ বেলো হারমোনিয়াম।
আনুমানিক ১৮৬০ সালে
জোড়াসাঁকোতে স্থাপিত শখের থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ
ঠাকুর প্রথম হারমোনিয়াম বাজান। সম্ভবত,
ভারতবর্ষে
এটাই প্রথম হারমোনিয়ামের ব্যবহার। রবির আর এক দাদা
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর শৈশবে বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর কাছে সংগীতের তালিম নিতেন। তিনি
পিয়ানো, ভায়োলিন, হারমোনিয়াম, সেতার বাজানোয় ছিলেন
দক্ষ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে আর সব বাদ্যযন্ত্র ছাড় পেলেও বৈমাত্রেয় ভাইয়ের
মতো ব্রাত্য হয়েছিল এই হারমোনিয়াম যন্ত্রটি।
শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন
মেটানোর জন্য উপযুক্ত গ্রন্থও রচিত হয়। শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের হারমোনিয়াম সূত্র
(১৮৭৪) এবং কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হারমোনিয়াম শিক্ষা (১৮৯৯) এ বিষয়ে প্রথম ও
প্রধান দুটি গ্রন্থ। গ্রন্থ দুটিতে হারমোনিয়াম বাদন সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা
আছে। রবীন্দ্রনাথের প্রাণের
শান্তিনিকেতনে হারমোনিয়াম নিষিদ্ধ হয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই নির্দেশে।
শৈলজারঞ্জন জানিয়েছেন, ‘শান্তিনিকেতনে এসে
দেখলাম হারমোনিয়ামের প্রবেশ সেখানে নিষিদ্ধ। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত ওই যন্ত্র আর
ছুঁয়েও দেখিনি।’ শান্তিদেব ঘোষ তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন ‘১৯২২ সাল থেকে অর্থাৎ
বিশ্বভারতীর যুগ থেকে হারমোনিয়াম যন্ত্রটির ব্যবহার গুরুদেব শান্তিনিকেতনে বন্ধ
করে দিয়েছিলেন।’ কলকাতা রেডিয়োর তৎকালীন স্টেশন-ডিরেক্টরকে রবীন্দ্রনাথ
১৯ জানুয়ারি ১৯৪০ তারিখে লিখছেন,
‘I have always been very much against the prevalent use of Harmonium for the
purpose of accompaniment in our music and it is banished completely from our
Ashrama. You will be doing a great service to the cause of Indian music if you
can get it abandoned from the studios of All India Radio.’ আকাশবাণী কলকাতা দীর্ঘদিন
ব্যান করে রেখেছিল হারমোনিয়ামকে। শুধু তাই নয়, যেসব সংগীতশিল্পী আজীবন শান্তিনিকেতনেই জীবন অতিবাহিত করেছেন তাঁদের মধ্যে
অন্যতম কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন এবং স্বয়ং
শান্তিদেব ঘোষ— তাঁরা কেউই যন্ত্রটি বাজাতে পারতেন না। কারণ, বাজানোর সুযোগই পাননি!
হারমোনিয়াম বাজাতেন মহানায়ক
উত্তম কুমার। 'উত্তমকুমারের হারমোনিয়ামটা
বেশ কিছুদিন আগে সারালাম। তার আগেও একবার সারিয়েছিলাম। টেবিল মডেলের চেঞ্জার।
বার্মাটিক কাঠের। উপরে লেখা 'উত্তমকুমার'। বেলো-চামড়া-প্লাইউড ঠিক করে পালিশ করেছিলাম। টিউনিং ঠিক
করেছিল আমাদের কারিগর নসুর হোসেন।' বাটালি দিয়ে
হারমোনিয়ামের 'বাঁশি'র রিডবোর্ড ঘষতে ঘষতে বলছিলেন কারিগর রহিত হাইত, বিগত তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে হারমোনিয়াম সারাই করে
চলেছেন রাসবিহারী মোড়ের ৮৫ বছরের বেশি পুরোনো দোকান 'দ্য মেলোডি'-তে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র নিয়মিত
আসতেন হারমোনিয়াম কিনতেই। মহানায়কের কথা বলতে বলতে ওই তিন মহাগায়কের কথা
সাধনবাবুর গলায়। ' হেমন্তবাবু মারা
যাওয়ার আগে যেবার বাংলাদেশে প্রোগ্রাম করতে গিয়েছিলেন, সেবার একটা হারমোনিয়াম কিনতে এসেছিলেন। বলেছিলাম, অত দূর যাচ্ছেন,
ভারী
টেবিল-হারমোনিয়াম কেন? হাল্কা পোর্টেবল নিন
না? শুনে উনি হেসে বলেছিলেন, 'আমাকে কখনও পোর্টেবল হারমোনিয়াম বাজাতে দেখেছেন?'
উত্তমকুমারের নিজস্ব
হারমোনিয়াম এখনও সযত্নে রাখা তাঁর ভবানীপুরের গিরিশ মুখোপাধ্যায় রোডের বাড়িতে। এখনও সারানো হয়।
দোকানের ৪২ বছরের পুরনো কর্মী
সাধন চৌধুরীর কথায়,- 'উত্তমকুমারের দুটো
হারমোনিয়াম ছিল। একটা ভবানীপুরে। একটা ময়রা স্ট্রিটে সুপ্রিয়া দেবীর বাড়িতে।
দ্বিতীয় হারমোনিয়াম কোথায় আছে, জানি না'। উত্তমের পুত্রবধূ মহুয়া চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি বলে, 'এই হারমোনিয়ামেই উত্তম গেয়েছিলেন, 'এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে।' গানটা রেকর্ড করেছিলেন ছেলে গৌতম। উত্তমকুমারের প্রয়াণের পর
তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দীর সঙ্গতে এ গান রেকর্ড হয়।
একদিন মান্না দে দুপুরে
এসেছিলেন হারমোনিয়াম দেখতে। তখন লোডশেডিং। আমাদের জেনারেটর নেই। কিন্তু তাতে তাঁর
কোনও হুঁশই নেই! একটা হারমোনিয়াম টেনে,
ধরলেন
নানা রাগরাগিণী। জানা যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় হারমোনিয়াম সারাতে এলে রেখে যেতেন
না। ভিতরে গিয়ে বসে পড়তেন অন্য হারমোনিয়াম টেনে। যতক্ষণ তাঁর হারমোনিয়াম সারানো
চলত, ততক্ষণ তিনি একটার পর একটা
গান গাইতেন। কারিগররা সেই গান শুনতে শুনতে কাজ করত। সাধনবাবুর গলায় ফিরে আসে
সুবিনয় রায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়,
প্রতিমা
বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতি। ওই ঘরে হারমোনিয়ামে সুর তুললেও আক্ষেপের করুণ সুর বাজে
রহিতের গলায়— 'এই পেশায় অনেক সময়, ধৈর্য লাগে বুঝলেন। আজকের প্রজন্মের সেই সময়-ধৈর্য কোথায়? তাই নতুন করে আর কেউ আসছে না এই কাজে। এখন তো হারমোনিয়ামের
চলও কমছে। অনেকেই এই পেশা ছেড়ে ফার্নিচারের লাইনে গিয়ে ঢুকেছে। কী করবে? পেট তো কথা শুনবে না।'
তাঁর
পরের প্রশ্ন, 'কষ্ট কী জানেন? অন্তরালে থেকে আমরা শুধু কাজটাই করে গেলাম। আমাদের কথা কেউ
কখনও ভাবলেন না।' চশমার ফাঁকে চিকচিক
করে রহিতের চোখ। 'আজ মৃৎশিল্পী, বেতশিল্পী, ভাঁড়শিল্পী, বিড়িশিল্পীদের কথাও ভাবা হয়। আর আমরা যারা আজও সংগীতশিল্পের
সঙ্গে জড়িয়ে, তাঁরা কি একটু
সম্মান-সাহায্য পেতে পারি না?’
আকাশবাণীতে হারমোনিয়াম
ব্রাত্য ছিল দীর্ঘ কাল, বিশ্বভারতীও খুব উঁচু
নজরে দেখেনি। আবার মন্টু বন্দ্যোপাধ্যায়,
জ্ঞানপ্রকাশ
ঘোষ প্রবাদপ্রতিম হয়েছেন হারমোনিয়াম বাজিয়েই। কেবল গ্রামোফোন নয়, বঙ্গগৃহকোণে হারমোনিয়ামেরও ছিল অবধারিত উপস্থিতি। এখনও আছে।
আর পুরনো হোক বা নতুন, খানপাঁচেক হারমোনিয়াম
চোখ বুজে বাছলেও দেখা যাবে তার বেশির ভাগেই জ্বলজ্বল করছে নির্মাতা সংস্থার নাম, ‘পাকড়াশী’। এই হারমোনিয়ামের দোকানে কলকাতায় এলেই ঢুঁ মেরেছেন
আলি আকবর খান, হারমোনিয়ামের সঙ্গে
পিচ পাইপের স্বর পরীক্ষা করেছেন। এসেছেন সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,
সলিল
চৌধুরী, মুনেশ্বর দয়াল, ভীষ্মদেব
চট্টোপাধ্যায়, চিন্ময় লাহিড়ী, ভি
বালসারা, জগজিৎ সিংহ... শাস্ত্রীয়, উপশাস্ত্রীয় বা লঘু গানের নানা উপচারের মধ্যে ধ্রুবক— সতত
সুরে বেজে চলা পাকড়াশীর হারমোনিয়াম। শ্রীমতী সীমা শিরোদকর আজ একমাত্র মহিলা
হারমোনিয়াম বাদক যিনি নিয়মিতভাবে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শীর্ষস্থানীয়
কণ্ঠশিল্পীদের সাথে সংগীত পরিবেশন করেন। কণ্ঠশিল্পীদের সাথে তাঁর সংগীত সকল সংগীতপ্রেমীদের কানে এক আনন্দের অনুভূতি
জাগায়। মেহমুদ ধৌলপুরী। ভারতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এবং বিখ্যাত হারমোনিয়াম বাদক, মেহমুদ ধৌলপুরী, পারভীন সুলতানা, পণ্ডিত ভীমসেন জোশী এবং পণ্ডিত যসরাজ সহ
অন্যান্য উচ্চপদস্থ কণ্ঠশিল্পীদের সাথে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন।
এ দেশে হারমোনিয়ামের জার্মান
রিড আসা বন্ধ হয়েছে ১৯৪৫-এ। ইটালিয়ান রিড কিছু পাওয়া যেত ’৬২ পর্যন্ত। সৌরাষ্ট্রের পালিতানা গ্রামে ঘরে ঘরে তৈরি হতে
শুরু করে শুদ্ধ কোমল কড়ি স্বরের ‘কাঞ্জিলাল’,
‘জীবনলাল’
নামধারী রিড, সযত্নে তাদের ‘সিজনড’ কাঠের
খোপে পুরে সুরের রণন তোলেন কারিগরেরা। বছরে আড়াইশো-তিনশো নানা মান ও মাপের যন্ত্র
তৈরি হয়। বহিরঙ্গে বিচিত্র ‘ফিনিশ’, ভিতরটি নিখাদ সনাতন।
অ্যাকর্ডিয়ন পিচের সে সব যন্ত্রের দেখা মিলবে রবীন্দ্রসদন, আকাশবাণী বা শহরের গানের ইস্কুলে। আমেরিকায় বঙ্গ সম্মেলনের
সহযোগিতায় সম্প্রতি এই দেশের নানা প্রান্তে নানা ব্র্যান্ডের খারাপ ও বেসুরো
হারমোনিয়ামে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে এসেছেন পাকড়াশীদের দলের কারিগরগণ। হারমোনিমের
পিচ নিয়ে ইউরোপের নানা দেশের নিয়ম। সনাতন ৪৪০ হার্টজ় পিচকে ৪৩২ করতে চাইছে ইউরোপ, ভারতে এ আর রহমান স্বীকৃতি দিয়েছেন তাকে। নতুন চ্যালেঞ্জের
পাশে সুফলবাবুর স্মৃতির ফ্রেম থেকে অক্ষয় এক গানছবি। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় বাদাম
ফাটিয়ে সেই শব্দের স্বরনির্ণয়ে বসেছেন পাকড়াশীর ঘরে হারমোনিয়াম হল সংগীত শিক্ষার
প্রাথমিক যন্ত্র। যে শিল্পীরা মঞ্চে এখন মাইক ব্যবহার করছেন তাঁদের রেওয়াজ কিন্তু
হারমোনিয়াম ছাড়া অসম্পূর্ণ। গলা তৈরি করা,
গলা
সাধার জায়গাতে এখনও হারমোনিয়ামই রয়েছে,
আগামীতেও
তাই থাকবে। হ্যান্ডক্রাফটেড এক হেরিটেজ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষের তীব্র
আবেগের সাক্ষী হারমোনিয়াম। তাই যুগের পরিবর্তনে কালের পরিবর্তনেও এর গুরুত্ব
বেড়েছে। আজ বিভিন্ন মিউজিকাল শো-গুলো নতুন করে প্রমাণ করে দিয়েছে হারমোনিয়াম
কোনওদিন হারিয়ে যাবে না।
বর্তমানে সংগীতের সহযোগী
বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়াম, তবলা কোণঠাসা হয়ে
পড়েছে। ইলেকট্রিক গিটার, কি বোর্ড, ড্রাম সেট সংগীতের জগতে পাকা জায়গা করে নিয়েছে। একদশক
আগেও শহর, মফস্সল থেকে
গ্ৰামগঞ্জের সাংস্কৃতিক উৎসব-অনুষ্ঠানে
হারমোনিয়াম তবলা শোভা পেত। স্কুল,
কলেজ, পাড়ার জলসায় হারমোনিয়াম ছাড়া চলত না। বাঙালি মধ্যবিত্ত
পরিবারের মেয়েরা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শিখত। তাই প্রায় প্রতিটি বাড়িতে
হারমোনিয়াম থাকত। মান্না দে থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়রা সারা জীবন হারমোনিয়াম
বাজিয়েই গান গাইতেন। সময় বদলে যাওয়ার আক্ষেপ এখন কারিগরদের গলায়। হারমোনিয়াম
চাহিদা কমতে থাকায় ঝাড়গ্রামের দক্ষ কারিগররা কাজ হারাচ্ছেন। তবে আঁধারিয়ার
বাজার এলাকায় ছোট দোকান ঘরে হারমোনিয়াম তৈরি এখনও হয়ে চলেছে। অরুণাভবাবুর বাবা
পেশায় শিক্ষক নিমাইচাঁদ মাসান্ত প্রায় নব্বই বছর আগে আঁধারিয়ার বাজারে দোকান
খুলে নিজের হাতে হারমোনিয়াম তৈরি করতেন। তৈরি হয়েছিল একাধিক দক্ষ কারিগর। পুরনো
দিনের সেই দোকান আজও টিকে রয়েছে। দোকান ঘরে ঢুকলেই দেখা যায় সেগুন গাছের কাঠের
পাটা ছড়ানো-ছিটানো। ঘরজুড়ে কাঠপালিশের গন্ধ। সার সার করে সাজানো ছেনি ও হাতুড়ি। সেই
সময়ে কলকাতা শহর থেকে হারমোনিয়ামের জার্মান রিড আনা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সময় সেই রিড আসা বন্ধ হলে ইতালিয়ান রিড আনা শুরু হয়। ষাটের দশক পর্যন্ত সেই
সরবরাহ চালু ছিল। অরুণাভ মাসান্ত-এর কথায়, "বাবাকে হারমোনিয়াম তৈরির নেশা পেয়ে বসেছিল।
হারমোনিয়ামের সুর নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন। তাঁর তৈরি হারমোনিয়ামের
সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাবার কাছেই আমরা দুই ভাইয়ের হারমোনিয়াম তৈরি
করা শেখা। ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর হারমোনিয়াম তৈরিকে পেশা
হিসেবে বেছে নিই।' হারমোনিয়াম তৈরির
জন্য মূলত সেগুন কাঠ লাগে। এছাড়াও পাইন ও ওক কাঠের প্রয়োজন হয়। একটা
হারমোনিয়াম তৈরি করতে প্রায় একমাস সময় লেগে যায়। রিডগুলো এখন গুজরাতের
সৌরাষ্ট্র থেকে কলকাতা হয়ে হারমোনিয়ামের রিড আসে। যার জন্য খরচ বেশি পড়ে।
জেলায় ওনারাই এখনও হারমোনিয়াম তৈরি করেন। এই শিল্প লুপ্ত
হওয়ার মুখে। কারিগরের দক্ষতার উপর নির্ভর করে হারমোনিয়ামের আওয়াজের মিষ্টত্ব।
বিনপুরের সিংপুরের বাসিন্দা অর্জুন পাত্রের কথায়, "হারমোনিয়াম কীভাবে তৈরি হয় তা নিয়ে আগ্ৰহ তৈরি
হয়েছিল। অরুণাভবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে উনি কাজ শেখাতে রাজি হন। কিন্তু এখন নতুন
করে হারমোনিয়াম তৈরির দক্ষ কারিগর তৈরি না হলে অচিরেই এই শিল্প হারিয়ে যাবে।
এই শিল্প বেশ চ্যালেঞ্জের
সম্মুখীন হয়েছে, প্রথমত যন্ত্রাংশ এবং
কাঁচামালের অভাব, দ্বিতীয়ত নতুন প্রজন্মের মধ্যে হারমোনিয়ামের প্রতি আগ্রহ
কমে যাওয়া। বোয়ালমারী উপজেলার টোংরাইল গ্রামের পল্লিগায়ক নিখিল চন্দ্র বিশ্বাস
বলেন, "প্রায় ৫০ বছর ধরে
পল্লিগ্রামের বৈঠকি গানের সঙ্গে জড়িত। এ গানের প্রধান বাদ্যযন্ত্র ছিল হারমোনিয়াম, ঢোল, খোল, বাঁশি, জুড়ি, তবলা। আগে গ্রামে দু-চারটি হারমোনিয়াম-তবলা ছিল। এখন
দু-তিন গ্রাম খুঁজলে একটি হারমোনিয়াম বা একজোড়া তবলা পাওয়া যায় না। ইলেকট্রিক না
থাকলেও গ্রামে সন্ধ্যার হারিকেনের আলোতে বৈঠকিসহ নানা গানের আসর বসতো। এখন সেই
গানের আড্ডা নেই, বাদ্যযন্ত্রের কদরও নেই।
বাংলাদেশের ফরিদপুর শহরের
‘ভিম অ্যান্ড কোং’ সংস্থার মালিক শংকর সরকারের কথায়, "প্রতিষ্ঠানটি ৮০ বছরের পুরোনো। পারিবারিক ব্যবসায় ১৮ বছর
বয়স থেকে এই পেশায় রয়েছি। বতমানে কাজকর্ম অনেক কমে গেছে। অনেকেই অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। বাবা-দাদার পুরোনো
পেশা তাই ছাড়তে পারি না। কোনোমতে আঁকড়ে ধরে টিকে আছি।
বর্তমান ডিজিটাল যুগে দেশিয়
বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার কমে গেছে এখন দখল নিয়েছে ইলেকট্রিক গিটার, কিবোর্ড, পিয়ানো, ড্রামসেট, ভায়োলিনের মতো
ভিনদেশি বাদ্যযন্ত্র। ফলে এ শিল্পে সেই সুদিন নেই। কাজকর্মও কমে গেছে। সংগীতের সঙ্গে থাকুক
হারমোনিয়াম, বেঁচে থাকুক হারমোনিয়াম
শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষজন।
তথ্যঋণ -
১. হারমোনিয়াম -মোবারক হোসেন
খান
২. কলকাতা কড়চা এক সুরে
একশো- ডিসেম্বর ২২ আনন্দবাজার পত্রিকা
৩. ঝাড়গ্রাম থেকে হারিয়ে যেতে
বসেছে হারমোনিয়াম তৈরি শিল্প- সুমন পাত্র
৪. সুমিত দে- এই সময়
৫. আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের
দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে হারমোনিয়াম-তবলা এন কে বি নয়ন -জাগো নিউজ
৬. রবীন্দ্রভাবনা,- টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মুখপত্র
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment