বাতায়ন/নৃপেন
চক্রবর্তী সংখ্যা/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/২৮ সংখ্যা/১৪ই কার্ত্তিক,
১৪৩২
নৃপেন চক্রবর্তী
সংখ্যা |
ছোটগল্প
উত্তম
ভট্টাচার্য
জীবনমৃত্যুর
যন্ত্রণা
"নিজের ছেলের ধর হতে আলাদা হয়ে পড়া মুন্ডুটাকে ফেলে না আসতে পেরে এতক্ষণ ধরে প্রসব যন্ত্রণার থেকেও শতগুন তীব্র মৃত্যু-যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে বুকের আলোয়ানটার নিচে কৌশলে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন।"
আগের দিন রাতেও ভাল ঘুম হয়নি
পার্বতীর। বাপের বাড়ির দিকটায় ক'দিন ধরে ভয়ংকর রাইট
শুরু হয়েছে। বেপরোয়াভাবে মানুষ মানুষকে খুন করে চলেছে। পেটের পেকে ওঠা সেলাই আর
বুকের ভাঁজে একটা নতুন অতিথিকে নিয়েই বিছানায় ছটফট করছিল পার্বতী। একনাগাড়ে
কেমন টনটন করতে শুরু করেছে জায়গাটা।
ওদিকে সন্ধ্যার পরে পরে পাশের
বেডে একজন বৃদ্ধাও এসে ভর্তি হয়েছেন। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন তিনিও। ধারাল
অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে তাঁকে। চাপ চাপ রক্তের দগদগে দাগ
এখনও যাঁর সারা শরীরজুড়ে। তবুও, হাসপাতালের বেডে
শুয়েও কেবল বাড়ির জন্য সারাটাক্ষণ মাথাকুটে চলেছেন সেই বৃদ্ধা-
'ওরে আমার বাপধন! তয় কোনে গেলি বাপধন!'
যদিও, রাতের ডিউটিরত নার্সরা তাঁদের সাধ্যমতো সেবা-শুশ্রূষার পরে জানিয়ে গেছেন,
-তুমি এখন ঘুমোও। কাল সকালে
ডাক্তারবাবুরা এলে আবার না হয় চিল্লাবে। এখন চিল্লিয়ে লাভ হবে না কোনো।
কিন্তু তবুও আর্তনাদ বন্ধ করা
যায়নি বৃদ্ধার! তবে, রাত যত গড়িয়েছিল
বৃদ্ধার সেই আর্ত-বিলাপ ক্রমেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে
পড়েছিল, আর চোখ দুটো কেবলই
কপাল ছেড়ে ঠিকড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল!
কিন্তু মুখে তখনও তাঁর একটাই
বিলাপ ফতফত করে ফেণার মতো উগলে উগলে পড়ছিল- 'ওরে আমার বাপধন!'
শেষে অনেক রাতের পরে নির্জন
ঘোলাটে আলোয় বৃদ্ধার যখন 'টান' উঠতে শুরু করেছিল- আর ঠোঁট দুটো সামান্য হাঁ করে 'পানি' 'পানি' আর্তি করছিল- তখন
নিজের কথা ভুলে গিয়েছিল পার্বতী! শুয়ে থাকতে পারেনি একমুহূর্তও! কাছে
গিয়ে হাতদুটি বাড়িয়ে দিয়ে ঠোঁটের ভাঁজে দু'ফোটা 'পানি' ঢেলে দিয়েছিল;
আর তা
দিতে গিয়েই প্রথম বুঝতে পেরেছিল- বৃদ্ধা তারই বাপের বাড়ির স্বজন!- যিনি তাঁর
নিজের ছেলের ধর হতে আলাদা হয়ে পড়া মুন্ডুটাকে ফেলে না আসতে পেরে এতক্ষণ ধরে
প্রসব যন্ত্রণার থেকেও শতগুন তীব্র
মৃত্যু-যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে বুকের আলোয়ানটার নিচে কৌশলে আঁকড়ে ধরে
রেখেছিলেন।
যা দেখে, জীবনের ভয়ে, আর্তনাদ করে কেঁদে
উঠেছিল পার্বতী, ছুটে গিয়ে বুকে
জড়িয়ে ধরেছিল নবজাতকের কান্না!
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment