বাতায়ন/শারদ/গদ্য/১ম বর্ষ/২২তম
সংখ্যা/১৯শে আশ্বিন, ১৪৩০
শারদ | গদ্য
মধুপর্ণা বসু
আমার শারদোৎসব, সেকাল থেকে একাল
এই যে সকাল থেকে কাজের মধ্যে ছুটে বেড়ানো, ঝকঝকে
একটা কাঠফাটা রোদের দিন, দুপুরের ফাঁকা রাস্তাঘাটে মানুষের নিঃশব্দ আনাগোনা, তারপর
দূর থেকে দু'একটা ঘুঘুর একলা ডাকে ঝিমিয়ে পড়া চোখে হঠাৎ দেখি, সবুজ স্কার্ট আর
সাদা শার্ট পড়ে বাড়ি ফিরছে কিশোরী মেয়েটি।
স্কুলে সেদিন একটা ছোট শরৎ অঞ্জলি সেরে
এক মাসের ছুটির আনন্দ, মাথার দুই বিনুনির উড়ন্ত দুরন্ত চাঞ্চল্যে ভরপুর তার দু’চোখ।
এবার পুজোর বাজার শুরু, দুই বোনের জন্য মা-বাবুর আদরে ক্লাস নাইন-টেনেও দর্জির
বানানো বিদেশি কাটের জামা তৈরি হত, বড় সুন্দর লহরী ছিল সেই দুর্গোৎসবের আসন্ন
দিনগুলোতে। আকাশে নীল সাদা তুলো তুলো মেঘের উদাস হাতছানি, হাওয়ায় ভাসত ছাতিমের
গন্ধে মায়ের আসার আনন্দমুখর আগমনী সুর। তখন জীবন ছিল পুতুল খেলার ঘর, নতুন হাইহিল
নিয়ে বালিশের পাশে রোমাঞ্চে ঘুম আসত রাতে। ঘুম ভাঙলে ছুট্টে গিয়ে জানলা থেকে ষোড়শী
দেখত পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে কাপড় পড়ল কিনা। তারপর সেই স্বপ্নিল প্যাণ্ডোরাবাক্স
নিয়ে বৃদ্ধ বায়োস্কোপওয়ালা আমাদের বিংশ, একুশের যন্ত্রযুগে ছুঁড়ে পাঠিয়ে দিয়ে
স্বপ্ন ফেরি করতে অন্য গ্রহে চলে গেছে।
সেই ষোড়শী স্নিগ্ধতা
কর্পূরের মতো উবে গিয়ে পঞ্চাশোর্ধে কেমন শক্ত মাটির জরাজীর্ণ বিংশ আর পেশাদার
হট্টমালার একবিংশে এনে স্থির করিয়ে দেয়। প্রৌঢ় হয়ে উঠেছে মন, রংমিলান্তী ছোটবেলা, যুবতী
দুপুর আর আসক্তির মধ্য-যৌবনের রাত কাটিয়ে এখন গভীর নিরাসক্তির ভোর। সেই বিশ্বকর্মা
পুজোর দিনে পেটকাটি, চাঁদিয়াল, সেই গেলাসী ময়ূরপঙ্খী, সুতোর গিঁট ছিঁড়ে উড়ে গেছে
অন্তহীন শূন্যে। আমার বাবু, কাকুরা দিকশূন্যপুরের স্থায়ী ঠিকানায় তাদের মেহফিল
সাজিয়েছে। আমার হাতের কাঠি কুলফি, পুজোর পাঁচদিনের নতুন জামা, সদ্য হাইহিলের
টালমাটাল ফোসকা পড়া লক্ষ্মীমন্ত পা, আমার তিরছি নজরে দেখা সদ্য গোঁফ ওঠা যুবকের
গলে যাওয়া আগুন হৃদয়, আমার অষ্টমীর সন্ধিপুজোর একশো আটটা দীপের অনির্বাণ শিখা
জ্বলতে জ্বলতে কেমন স্থির, নিস্প্রভ মলিন হয়ে আমাকে ঘিরে বিসর্জ্জনের ঢাক
বাজাচ্ছে।
কতটা পরিবর্তনের স্রোতে
আমি, তুমি, আমরা ভেসে চলেছি। কতটা গুরুত্বহীন জাঁকজমকে, অপ্রয়োজনীয় বাহ্যিক লোক
দেখানো আড়ম্বর আয়োজনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার খতরনাক
ঘোড়দৌড়ে মেতেছি।
তবুও কিছুতেই ভুলতে
পারি না নিজের শিকড়, নিজের ঐতিহ্য। আজও মহালয়ায় মহিষাসুর মর্দিনী শুনলে বুকের
মধ্যে বেজে ওঠে ছোট-মা’র শাঁখ বাজিয়ে ঘরে ঘরে দরজার মাথায় সিঁদুরের স্বস্তিক চিহ্ন
এঁকে বাড়ির সদরে পিতলের ঘটিতে জল ঢেকে দেবীপক্ষের শুরু করা, আমরা বোনেরা মিলে মগ্ন
হয়ে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ শোনা, "ওগো আমার আগমনী আলো", সে ছিল এক জানার বোঝার
আর উপলব্ধির আলো। আমি আধুনিক, এ-যুগের বর্ণপরিচয় পড়েছি, গতির সাথে নাগরদোলায়
উঠেছি। জীবনকে নতুন করে একুশের চোখ দিয়ে দেখছি। উৎসবের আনন্দের আঁচ গায়ে এসে
লাগলেও ভুলতে পারছি না...
এ শরৎ তোমার আমার কাছে
কিছু অস্বচ্ছ প্রশ্নের হয়ে আছে।
এ শরৎ আকাশ কল্পনার নয়
এই শারদীয়া দুঃশ্চিন্তার সমন্বয়।
আমার শরৎ, আমার উৎসব আমি রেখে এসেছি যেন আরও কয়েক যুগ আগে। এখন সব ঋতুতে বারুদের
গন্ধ, আমার সাধের কাশফুল, শাপলা শালুকে রক্তের ছিটে, কালসাপেরা বিষাক্ত নিঃশ্বাস
ফেলছে ভালবাসা আর কোলাকুলির উদার নীল আকাশে।
আমার কাছে উৎসব মানে মেলামেশা, আনন্দে একে অন্যকে জড়িয়ে নেওয়া, বেঁধে বেঁধে থাকা। আমার
কাছে শারদীয়া হল হৃদয়ের কোলাকুলি, পুরনো স্মৃতির আদরে আখরে মাজা-ঘষা করে অভয়া
শক্তির উপাসনা।
সমাপ্ত
খুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteভীষন সুন্দর লেখা,ভীড় করছে সেই ফেলে আসা দিন গুলো
ReplyDelete