বাতায়ন/শারদ/ছোটগল্প/১ম বর্ষ/২২তম
সংখ্যা/১৯শে আশ্বিন, ১৪৩০
শারদ | ছোটগল্প
সুশান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
তালা-চাবি
আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ
দেখলে লোকের আনন্দ হয়। শরৎকাল এসেছে।
সামনেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান দুর্গা পূজা। সমৃদ্ধিরও আনন্দ হয়। আবার একটু দুঃখও
হয়। বৌ, ছেলেমেয়েকে নতুন জামা কাপড় কিনে দিতে হবে। সমৃদ্ধি বড়বাজারে একটা দোকানে ক্যাশে
বসে। মালিক ভদ্রলোক আসেন দুপুরে। হিসাব বুঝে সন্ধ্যার আগেই আর একটা দোকানে চলে যান।
সমৃদ্ধিকে খুবই স্নেহ করেন। এই তো সেদিন বলছিলেন,
- তোমার মতো এত লেখাপড়া জানা
লোক ক্যাশ বাক্স সামলাচ্ছে, এটা আমার দেখতে ভাল লাগে না।
অথচ বেতন কখনও
বাড়াননি। গত ছ’ বছর ধরে একই আছে। দশ হাজার টাকা। ওদের শাড়ির দোকানে ভিড় লেগেই থাকে।
কত রকমের যে শাড়ি আছে। সব থেকে কম দামের শাড়ির দাম আড়াই হাজার টাকা। সমৃদ্ধি বহুবার
ভেবেছে যে ওর বৌয়ের জন্য একটা শাড়ি নিয়ে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভেবেছে, আড়াই হাজার টাকা চলে গেলে মার ওষুধ, ছেলে-মেয়ের স্কুলের বেতন
কীভাবে দেবে? মার ডায়াবেটিস।
তিন-চারটে ওষুধ নিয়মিত খেতে হয়। বাবার চোখে ছানি পড়েছে। এখুনি অপারেশন না করালেও চলবে।
তবে করাতে তো হবে।
ইদানীং সকালে দুটো
টিউশন করছে। সকাল সাতটা থেকে সাড়ে নটা। তারপর বাড়িতে এসে নাকেমুখে যা হোক কিছু দিয়ে দশটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। দোকান বন্ধ করে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। সমৃদ্ধি মনে
মনে ভাবে, ওর কপালটাই খারাপ। নয়তো স্কুল মাস্টারের লিস্টে নাম উঠেও হাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট
লেটার পাচ্ছে না। দুনিয়ার আইনের মারপ্যাঁচে আটকে আছে। এই তো সেদিন দোকানের মালিক বলছিল,
- আরে বাবা পয়সা খাওয়াও। বাংলা দেশের লোকেরা পয়সা ছাড়া
কিছু বুঝে না। তুমি পয়সা দিবে না, তুমার নোকরি ভি হোবে না। সে রকম হলে আমার থেকে টাকা
ধার নাও, নোকরি পেলে ফিরিয়ে দিও। আমার কিছু টাকা হোয়াইট হয়ে যাবে।
সমৃদ্ধির বৌ খুব
গোছানো স্বভাবের। এর মধ্যে টাকা জমিয়ে বাচ্চা দুটোর জন্য আর শাশুড়ির জন্য যা হোক কিছু
একটা কিনে এনেছে। সেই জামা দেখে বাচ্চা দুটোর কী আনন্দ! কিন্তু মা মুখ হাঁড়ি করে বলে,
- বৌমা নতুন শাড়ি
না পরলে এ শাড়ি আমি পরব না। তুই এই শাড়ি
ফেরত দিয়ে বৌমার জন্য একটা ভাল
শাড়ি নিয়ে আয়।
সমৃদ্ধির বৌ এসে
বুঝিয়ে বলে,
- পুজোর চারদিন
তো ওদের দোকান বন্ধ থাকবে। তখন আমি তোমার ছেলের সঙ্গে গিয়ে পছন্দ মতো শাড়ি কিনে নিয়ে
আসব।
সেই কথা শুনে মা
খুশি হয়ে শাড়ি তুলে রাখে।
আজকে ষষ্ঠী। কাল
থেকে চারদিন দোকান বন্ধ থাকবে। দুটো বাচ্চা আর মায়ের শাড়ি ছাড়া কিছুই কেনা যায়নি। সমৃদ্ধির
মনটা খচখচ করছিল। দোকান বন্ধ করার পর সমৃদ্ধির ডিউটি হচ্ছে কাগজে আগুন জ্বেলে তালাগুলোকে আর একবার দেখে নেয়া। এই কাজটা সব দোকানদার করে। মালিক সেদিন বলছিল,
- আপনার ওপরে আমার
অঘাত বিশ্বাস। সেইজন্য দোকান বন্ধ করার কাজ আপনাকে দিয়েছি।
ভদ্রলোক মাড়োয়ারি।
তবে দুই পুরুষ ধরে কলকাতায় আছেন। তিন-তিনটে দোকান সামলান। সকালে ঢাকুরিয়া, দুপুরে বড়বাজার আর বিকেলে কলেজ স্ট্রিট।
গত রাতে সমৃদ্ধির
বৌ কাছে এসে বলেছিল,
- কী গো এবার পুজোয়ও
কিছু দেবে না। সে ঠিক আছে। চারদিক সামলে তুমি পেরে উঠছ না। তবে সবাই নতুন শাড়ি পরে
তো। ওদের দেখে মনটা কেমন করে ওঠে।
তারপর শাড়ি কাপড়
গুছিয়ে বলে,
- সে যাই হোক।
স্কুল মাস্টারের চাকরিটা পেলে কিন্তু আমার নতুন শাড়ি চাই।
এখন রাত নটা। সব
দরজায় তালা দেয়া হয়ে গেছে। সমৃদ্ধি আগেই ওর ব্যাগে একটা শাড়ি ঢুকিয়ে রেখেছে। কাগজে
আগুন জ্বেলে তালাগুলো দেখতে দেখতে মালিকের
কথা মনে পড়ে গেল- আপনার ওপর আমার অঘাত বিশ্বাস…
হঠাৎ সমৃদ্ধি বলে,
- একটু তালাগুলো
খুলবে। ভুল করে একটা শাড়ি আমার ব্যাগে রেখেছি। ভেবেছিলাম পরে গুছিয়ে রেখে দেব।
- ধুর, আপনারও
যেমন কথা। এতগুলো তালা আবার খোলা চাট্টিখানি কথা। ও থাকুক। আপনার কাছেই থাকুক। আমি
ছাড়া আর কেউ তো জানছে না।
দোকানের কর্মচারী
জবাব দেয়।
- না। তুমি তাহলে
চাবিগুলো দাও। আমিই খুলছি।
- থাকুক। অত পরিশ্রম
করতে হবে না। একদম ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির।
সমৃদ্ধির নিজেকে কেমন হালকা হালকা লাগে।
সমাপ্ত
খুব ভাল লাগল। পুজোর সময়ে নিম্ন মধ্যবিত্তের মানসিক আর আর্থিক দুর্বলতা খুবই প্রাসঙ্গিক ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক।
ReplyDeleteKhub bhalo laglo ...
ReplyDeleteখুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteসকলকে ধন্যবাদ।🙏
ReplyDeleteসবাই কে ধন্যবাদ।🙏
ReplyDelete