প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

রং | প্রতিজ্ঞা

  বাতায়ন/ রং /সম্পাদকীয়/২য় বর্ষ/ ৩ ২তম সংখ্যা/ ২৯শে ফাল্গুন ,   ১৪৩১ রং | সম্পাদকীয়   প্রতিজ্ঞা "নির্ভীক একটি ফুলের মতো মেয়েকে চরম লাল...

Saturday, June 8, 2024

বিস্মৃতবীর | সুনন্দিনী শুক্লা

বাতায়ন/সাপ্তাহিক/ধারাবাহিক/২য় বর্ষ/৪র্থ সংখ্যা/২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১

ধারাবাহিক গল্প

সুনন্দিনী শুক্লা

বিস্মৃতবীর

[৭ম পর্ব]

পূর্বানুবৃত্তি জালালাবাদ পাহাড়ের উপকণ্ঠে সশস্ত্র ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ লড়াই শুরু হল। ন্যাড়া পাহাড়ের মধ্যে নিজেদের লুকানোর জায়গা ছিল না। টেগরা তার মধ্যেই পজিশন চেঞ্জ করতে গেল, মুহূর্তে একটা বুলেট তার বুকে ঢুকে গেল। যে ক’জন পেরেছিলাম সন্ধে নামার আগে পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়েছিলাম। প্রীতিলতা যোগ দিল মাস্টারদার সঙ্গে। তারপর…
 
নির্মল দা অতি কষ্টে বললেন,
- সূর্য আমার দ্বারা হবে না। রাণীকে নিয়ে পালাও।
সূর্যদা বললেন,
- ছেলেমানুষি কোরো-না নির্মল। ওঠো।
শুষ্ক মুখে হাসলেন নির্মলদা, অত কষ্টের মধ্যেও।
-আমি যে ভাই সত্যিই পারব না উঠতে। আমায় যেতে হবে। এটুকুই থাকতে পারলাম তোমাদের সাথে। দেরি করো না, যাও, যাও শিগগির। ভবিষ্যতের দিকে তাকাও সূর্য, অনেক বড় বিপ্লব সামনে অপেক্ষা করছে, যাও।
শিক্ষাগুরু নির্মল সেনের পায়ের কাছে বসে কেঁদেই চলেছে প্রীতি। বাহু ধরে জোর করে টেনে তুললেন তাকে সূর্যদা। তার চোখে জল সহজে দেখা যায় না, কিন্তু অতি কষ্টে এখন কান্না চেপে রেখেছেন তিনি। প্রীতিকে নিয়ে টানতে টানতে বেরিয়ে গেলেন পিছনের দরজা দিয়ে।
রাণীর জন্য একটা উপযুক্ত আশ্রয় কেন্দ্র খুঁজতে হবে। যেখানে সেখানে ওকে রাখা চলে না। পরৈকড়ার রমণী চক্রবর্তীর বাড়িতে রাণী আশ্রয় নিল। মাস্টারদার নির্দেশে পূর্ণরূপে গৃহত্যাগ করেছে সে। সংবাদপত্রে বেরিয়েছে।
- 'চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ধলঘাটের শ্রীমতি প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার গত পাঁচই জুলাই মঙ্গলবার চট্টগ্রাম শহর হইতে অন্তর্ধান করিয়াছেন। তাহার বয়স উনিশ বৎসর। পুলিশ তাহার অনুসন্ধানের জন্য ব্যস্ত।'
মাস্টারদা বোঝেন আর দেরি করা যাবে না। যে কাজের জন্য এই মেয়ে ঘর ছেড়েছে তা  তাড়াতাড়ি সমর্পণ করতে হবে। রাণীর অস্থিরতা উনি বুঝতে পারেন। দলের আস্তানায় রাণীর কঠোর অনুশীলন তিনি লক্ষ্য করেন। সে প্রস্তুত হচ্ছে। ক্রমাগত প্রস্তুত হচ্ছে মহাবলিদানের জন্য। রাণীকে ডেকে পাঠান তিনি। অনুশীলন করছিল সে। ঘাম মুছতে মুছতে কোমরে আঁচলটা জড়িয়ে এসে বসল।
- বলুন দাদা।
- শোন বলছি পরের অভিযানের নেতৃত্ব তুই দিবি, বুঝলি?
প্রীতি হকচকিয়ে গেল- আমি! মানে, আমি পারব...?
মাস্টারদা এবার পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন।
- পারবি না? এটা করতেই তো এসেছিস ঘরবাড়ি ছেড়ে। দেখ দিদিভাই, তোকে সৈনিক থেকে সোজা ক্যাপ্টেন বানিয়ে দিলুম, কেমন! একেবারে লিডার।
রাণীর মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার মনের ভেতরে ঝড় চলছে।
- কী করতে হবে দাদা। বলো। কোথায় আক্রমণ করতে হবে।
ইউরোপিয়ান ক্লাব। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মাস্টারদা বললেন,
- বীরেশ্বর প্রফুল্ল আর পান্নাকে ডেকে নিয়ে আয় তো। কালীকিঙ্কর আর শান্তিকেও ডাকবি। ও হ্যাঁ, মহেন্দ্র আর সুশীলকেও ডাক।
আমি মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলাম। ছেলেপিলেগুলো তো এক জায়গায় থাকত না। সারাদিন ছোটাছুটি করে বেড়াত। খুঁজে পেতে সব ক’টাকে ধরে নিয়ে মাস্টারদার সামনে এসে হাজির করলাম।
- বস।
সবাই বসে পড়ল। একটা ম্যাপ খুলে মাদুরের উপর বিছিয়ে মাস্টারদা বললেন,
- এই হলো গিয়ে ইউরোপিয়ান ক্লাবের বিলিয়ার্ড হল। এইখানে থাকবি বীরু, প্রফুল্ল, পান্না। হলঘর, যেখানে আসল সাহেবদের আড্ডাটা বসে, ওখানে থাকবি রাণী কালী আর শান্তি। আর সুশীল আর মহেন্দ্র সামনের দরজাটা তোরা দেখবি। সবাই পড়বি লুঙি আর শার্ট আর রবার সোলের কাপড়ের জুতো। রাণী তুই পড়বি মালকোঁচা মারা ধুতি, বুকে থাকবে লাল ব্যাজ, মাথায় পাগড়ি। সবার পকেটে একটা জবানবন্দি থাকবে। সেগুলো তোমরা নিজেরা লিখবে, কেন এই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছ , কী তোমাদের উদ্দেশ্য, সে সবকিছু লিখে রাখবে। মনে রেখো ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছ তোমরা। শেষ সময় যেন কোন দুর্বলতা তোমাদের বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। তোমাদের এই অভিযানের নেতৃত্ব দেবে প্রীতিলতা। চরম মুহূর্তে যাই হোক ওর নির্দেশ সবাই অক্ষরে অক্ষরে মান্য করবে। ওর উপরে কোন কথা বলবে না। সবাই মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল মাস্টারদার আদেশ শিরোধার্য। দিন ঠিক হল ২৪শে সেপ্টেম্বর ১৯৩২।
২৩শে সেপ্টেম্বর। সন্ধেবেলায় রাণী ঢুকল মাস্টারদার ঘরে। চোখের উপর হাত দিয়ে মাস্টারদা শুয়ে ছিলেন খাটিয়ায়। রাণীকে আসতে দেখে উঠে বসলেন। পিলসুজটা টেনে নিয়ে রাণী বসে পড়ল।
রাণীর হাত দুটো ধরে মাস্টারদা বললেন- রাণী, তৈরি তো?
রাণী কোন উত্তর দিল না। তার চোখে মুখে বিচিত্র সব ভাব খেলা করছে।
আঁচল থেকে একটা কাগজে বের করল সে। বলল,
- দাদা, এই জবানবন্দিটা একটু শুনুন।
- আহা এখন এসব কেন? লিখেছিস তো, তোর কাছে রেখে দে না।
- আপনি শুনুনই না - বলে রাণী পড়তে শুরু করল।
"Females are determined that they will no more lag behind and will stand side by side with their brothers in any activity however  dangerous or difficult. I earnestly hope that my sisters will no longer think themselves weaker and will get themselves ready to face all dangers and difficulties and join the revolutionary movement in their thousands. With an invocation to God I launch to discharge my today's responsibility and pray to him to purge me clean so that I may be a worthy offering to him."
সম্পূর্ণটা পড়া শেষ করল রাণী। মাস্টারদা একটা ঘোরের মধ্যে শুনছিলেন। উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো রাণী। মৃদুস্বরে বলল-
- দাদা একটা অনুমতি চাইব?
- হ্যাঁ বল না! কী চাই বল?
- দাদা, আমি কিন্তু আর ফিরব না!
সটান উঠে দাঁড়ান মাস্টারদা। কঠিন কণ্ঠে বলেন,
- ছেলেমানুষি কোরো-না প্রীতি। একটা সৈনিককেও হারানো এখন আমাদের বুকে শেলের মতো বিঁধবে। এমনিই আমাদের লোকবল কম।
- একজনকে তো জীবন দিয়ে শুরু করতে হবে দাদা। লোকে ভাবে মেয়েরা দুর্বল, মেয়েরা অক্ষম। এই ভুল আমি ভাঙব। বাঘাযতীনের শেষ কথাটা মনে করুন - we shall die to awaken the nation. আমি মেয়েদেরকে জাগানোর জন্য মরব। দেশের জন্য প্রাণ দেব। না করবেন না, দাদা, অনুমতি দিন!
সূর্যদা চোখমুখ শক্ত করে জানালার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রীতি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর প্রণাম করে বেরিয়ে যায়।
 

ক্রমশ…

No comments:

Post a Comment

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)