প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

দহন | মানুষকে মানুষের মূল্য দিন

বাতায়ন/দহন / কবিতা / ৩য় বর্ষ/৬ষ্ঠ সংখ্যা/১লা জ্যৈষ্ঠ ,   ১৪৩২ দহন   | সম্পাদকীয় "এর মধ্যেই আছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সে-কোন সন্ত্রাসবাদীই হ...

Thursday, July 4, 2024

ভুলু | আদনান খান

বাতায়ন/ত্রৈসাপ্তাহিক/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/৬ষ্ঠ/যশোধরা রায়চৌধুরী সংখ্যা/২১শে আষাঢ়, ১৪৩১

যশোধরা রায়চৌধুরী সংখ্যা | ছোটগল্প

আদনান খান

ভুলু


"আমি জন্ম নিলুম পোথ্যম দুই-চারদিন জোর করিয়াই আমার মাতার বাঁটে লাগায়ে দিতেছিল বটে, যেই বয়স মাস খানেক হইল, শুরু হইল তাহাদের দুগ্ধ শোষণ।"


জসীমের গৃহপালিত বকনা বাসুরটির কথোপকথন উল্লেখ করা হইল—
“আমি হলাম জসীম ডাকাতের বাড়ির বকনা বাসুর। তাহাকে ডাকাত বলিবার কারণ আছে বৈকি! আপনারা মনে করিয়েন না মানুষের গলায় ছুরি ধরিয়া লুট চালানোর লাগি আমি তাহারে ডাকাত বলিতেছি। বরং সে আমারে রশিবদ্ধ করিয়া মনের সাধ-আহ্লাদ শোষণ করিতেছে এ জন্য তাহারে ডাকাত বলিতেছি। রশি তো আমারে 

বাঁধিয়াছে কয়েকদিন আগ হইতে, মাঝেমধ্যে রশি খুলিয়া দিত তখনই তো ডাকাত জসীমের আসল চরিত্র ফুটিয়া উঠিত। ওহ! আরেকখান বার্তা আপনাদিগকে প্রদান করা উচিৎ গেরস্তর পুত্র নিলয় সংক্ষেপে নিলু তাহার নামের সহিত মিল রাখিয়া, আমার জনমদিনে নাম রাখিলো ভুলু। ঐ যে জন্মের পর হইতে আমারে শোষণ করিয়া আসিতেছে তাহার ব্যাখ্যা তাহলে শুরু করা যাক-
আমি জন্ম নিলুম পোথ্যম দুই-চারদিন জোর করিয়াই আমার মাতার বাঁটে লাগায়ে দিতেছিল বটে, যেই বয়স মাস খানেক হইল, শুরু হইল তাহাদের দুগ্ধ শোষণ। কুকুরের ন্যায় যদি আমার গোটা পাঁচেক ভাই হইত তবে ঐ মানুষের প্রতি বিদ্রোহ করিতাম। সক্কাল-সক্কাল মাতাস্তনে দুগ্ধের টান পড়িতে মাতা ডাক ছাড়িত। আর্তনাদ করিত, বলিত— ওরে কেউ দুধ দহন করিয়া লইয়া যা না বাছা! আসিতো-তো না-ই বরং আমি যে দৌড়াইয়া গিয়া চুমুক মারিবো তাহারও উপায় নাই, গলায় রশি বাঁধিয়া মাতার চক্ষু সম্মুখে বাঁধিয়া রাখিতো। হায়রে লোভ হইত! যেন একচুমুক মারিয়া সব কত-কত করিয়া গিলিয়া ফেলি। তাহার কোনো উপায় নাই, ঐ যে দহনের সময় একটু পিচ্ছিল করিবার লাগি আমারে ধরিয়া লইয়া মুখ লাগাইয়া দিত, তখন দুই-এক চুমুক মারিতাম। তাও আর হইত কই? একটা যেই চুমুক দিয়া দুগ্ধযাত্রাপথ পরিষ্কার হওয়া মাত্র দুধ বাহির হইতেছে, সহসা মুখ ধরিয়া আরেকটা বাঁটে লাগাইয়া দেয়। আবার নতুন করিয়া দুগ্ধ টানিয়া আনিতে হয়। এই করিতে করিতে আমার দুগ্ধপান আর হইয়া ওঠে না। স্তন পিচ্ছিল করিয়া পুনশ্চ আমারে বাঁধিয়া রাখিয়া দেয়। উহাদের এই কর্মকাণ্ড দেখিয়া ভাবিতুম–মাতার পায়ের তো জোর বেশি! দুগ্ধ দহনের সময় এক লাথি মারিলেই তো ব্যাটাদের লজ্জা হয়, পরে লক্ষ্য করিয়া দেখি, হায় হায়! আমার আম্মাগাভীর পেছনের পা দুটিও জড়াইয়া বাঁধিয়া রাখিয়াছে। এই হইল আমার শিশু কালের শোষিত ঘটনা। তারপর আস্তে আস্তে মাতৃদুগ্ধ ছাড়িয়া দিলাম। মধ্যে মধ্যে দয়া দেখায়ে গলা হইতে রশি খুলিয়া দিত। সাবালিকা হইয়া উঠিয়াছি, সকল খাদ্য হজম করিতে সমস্যা হয় না। কচি সবুজ বনঘাস, গাছের পাতা, খ্যাড়-পোয়াল, সব পছন্দ হইয়া উঠিল। মাঝেমধ্যে রুচির দুর্ভিক্ষ আসিলে গেরস্ত জসীম নালীগুড় আনিয়া গুলাইয়া খাইতে দিত। মাঝেমধ্যে কে জানি আসিতো, প্রথমত খাজুর পাতা আমার অপছন্দের জিনিস খাইতে গেলে উহার কাঁটা ফুটিয়া যায়, ঐ নতুন ব্যাটা আসিয়া খাজুর কাঁটার মতো চোখা জিনিস আমার পিঠে হানাইয়া দিয়া চলিয়া যাইতো। ভাবি, ব্যাটারে একদিন বাগে পাইলে আমারও শিং আছে একেবারে হানায়ে দিতে পারি, কিন্তু সে সুযোগ আসে না। মুখরোচক খাদ্য কাহারই না প্রিয়, সে সুযোগও আসে, মদ্যে মদ্যে ভুসি, খৈল আনিয়া নাস্তা করিতে দেয়, সে কী স্বাদ!
কিন্তু সমস্যা হইল চারিপাশে এত জিনিস দেখি, একাএকা খাইতে যাই, তখন যত বাধাবিপত্তি। আমাদিগণের কী কোনো নিজ স্বাধীনতা নাই? সেদিন নিলু রশি ধরিয়া কোথায় নিয়া যাইতেছিলো- গোসর দিয়া রাখিবে। দিয়া রাখিলো। পাশে দেখলুম ন্যাড়া বাতেন কচি আঁখগাছ লাগায়ে পরিচর্যা করিতেছে, ভাবলুম এত সুন্দর গাছ হইয়াছে, দুই-একটা চিবোয়ে আসি। মাটি নরম আছিলো, গোসর খুলিয়া দিলেম দৌড়, চিবোচ্ছি, চিবোচ্ছি গোটা দশেক চিবোলেম। ওহ্‌ গাই! কী মজার খাবার, ড্যাম! ঐ দেখলুম ন্যাড়া বাতেনের বৌ গলা ছাড়িয়া লাঠি লইয়া তাড়িয়া আসতেছে, কোনোমতে বাঁচিবার পর বাড়ি আসিলাম। ন্যাড়া বাতেনের কথা শুনিয়া জসীম আমার ওপরে রাগ দেখায়ে ঘায়ে মারিলো। ক্যানে মারিলো? পৃথিবী কী বলি শুধু ওদের? আমাদের খাওয়ার অধিকার নাই? আচ্ছা তা গেল, আরদিন মনের সুখে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি, পাশে দেখি টাটকা ন্যাপিয়ার-পাকচুং ঘাস। একটা পাতা ছিঁড়িয়া মাত্র মুখে ধরিয়াছি, ঐ ভুতে কাশেম হায় হায় করিতে করিতে ছুটিয়া আসিলো। সেদিন আর গেরস্তর নিকটে মার খাইতে হয় নাই, তবে ভুতে কাশেম দুই-চারটে বাড়ি মারিয়াছিলো, কিন্তু লাগে নাই। আরদিন দেখি কালুচাঁদ কচি মেহগনি গাছ লাগায়েছে। ভাবলুম পেট ভরা, লাগানো সম্পূর্ণ হউক, পরে আসিয়া একটু গাছের চলা চিবাইয়া যাবো। দুদিন পর ছাড়া পাইতেই আসলুম, গাছের চলায় জিভ ঠ্যাকায়েছি কী! ও মাগো! গোবর মাখায়ে রাখিয়াছে ব্যাটা, সেদিন আর খাওয়া যুতের হইলো না। তবে মুখের নিকটে দুইটা পাতা দেখিয়া খুলিয়া নিয়া আসলুম, তাও দোষ হইয়া গেল, যাকগে ও-আমি গায়ে লাগাইলাম না। তবে সুযোগ একদিন পাইয়া গিয়াছিলুম প্রায়, যদু চোকে দেখিতে পায় না, তাই সবে যদুকানা বলিয়া ডাকে। বাড়িতে ঐ যে খুদে বরকি পালে। তা ও বরকি কী অত খাইতে পারে নাকি! কানা হইয়া পাখি খাওয়া গোটা দশেক আম পানি দিয়া ভিজাইয়া, সাথে পোয়ালকুচি, ভুসি দিয়া চরম মাখায়েছে। তা সেদিন আমি চুমুক মারিয়া সব খেলুম সাথে আম মাত্র খাইতে শুরু করিয়াছি, যদুকানা টের পাইতো না যদি-না তাহার বৌ ঘর হইতে না চ্যাঁচাইতো। এই হইলো কিছু শোষণের নমুনা। এবার নিকৃষ্ট মানবের কিছু নমুনা তুলিয়া ধরি, আমি তকন মাত্র ঘাস খাইতে শিখিয়াছি, আমার সহিত পাশের বাড়ির ষাঁড় বাসুর ভাসান, তাহার সহিত খেলিতেছিলাম। খেলার নাম শিংঘসা। সে আমার নতুন ওঠা শিং-এ লাফায়ে উঠিয়া মারিতেছে, আমিও তাই করিতেছি! হঠাৎ দেখলুম কাঁঠালতলায় খসখস শব্দ হইতেছে। ভাসান তাহা দেখিয়া খবর লইতে গেল। দেখিলো নীচে কেহ নাই তবে উপরে নায়েকসুধার পুত্র কাঁঠাল পাড়িতেছে। আমিও হাঁটিয়া হাঁটিয়া এগোইতেছি। উপর হইতে ধপ করিয়া একখান কাঁঠাল পড়িলে ভাসান খুশি হইয়া দুই-এক কোয়া মুখে তুলিয়া খাইতে শুরু করলে, নায়েকের গেছো পুত্র তাহা খেয়াল করে নাই। হঠাৎ নায়েক আসিয়া বন্ধু ভাসানের দুই শিং-এর মাঝবরাবর বাঁশ তুলিয়া বাড়ি মারিলো, ভাসান লুটায়ে পড়িলো, কোনো সাড়া নাই। আমি আর এগোলুম না। পরে সবাই দৌড়াইয়া আসিয়া মৃত ঘোষণা করিলো। গোরুদের কী কোনো নেত্রবারি হইতে পারে? পরে শুনিলাম নায়েকের সহিত ভাসানের গেরস্তর তুখর ঝামেলা আছিলো আর উহার প্রতিক্রিয়া পড়িলো গোরু জাতে। কয়েকদিন আগে আমার মাতারেও বেচিয়া দিল। একা থাকিলাম। তারপর আমার গোয়াল আলো করিয়া আমার পুত্র আসিলো। নিলু তাহার গ্রীবা ধরিয়া আদর করিতো, আমারো ভাল লাগিতো। আমার পুত্রের বেলায়ও সেই শোষণ। হেথায়-হোথায় মুখ দেওয়া নিষেধ। তবে ভাসানের মতো না মরিতে চাহিলে রশিবদ্ধ থাকাই উত্তম। গেরস্ত ঈশ্বর বোধয় ভালর জন্যই স্বাধীনতা দেন না। কী জানি! গোরু হইয়া অতসব বুঝিনে।
 

সমাপ্ত

1 comment:

  1. বেশ অন্য রকম লাগল - জয়িতা বসাক

    ReplyDelete

জাল— মাছ কাটতে না জানলেও কিছু মানুষ জানে


Popular Top 10 (Last 7 days)