বাতায়ন/মাসিক/ধারাবাহিক গল্প/২য় বর্ষ/২৮তম
সংখ্যা/২রা ফাল্গুন, ১৪৩১
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সংখ্যা | ধারাবাহিক
গল্প
তুষার সরদার
দুটো
সাতের শেওড়াফুলি লোক্যাল
[১ম পর্ব]
"তার খুব গা ঘেঁষে বিহান বসেছে। কখনও একটু কম গা ঘেঁষে বসলেই সে ভুরু কুঁচকে বিহানকে বলে - ওভাবে সাতমাইল দূরে বসে আছ কেন? আমি তোমার কাছে অস্পৃশ্য নাকি? বিহান তখন সেই কবোষ্ণ কোমল দেহের সঙ্গে লেপটে বসে। তবেই তার বিজয়িনী ঠোঁটে হাসি ফোটে।"
সরকারি
অফিসের উচ্চপদস্থ চেয়ারে বসা-অবস্থা থেকে তুলে দাঁড়-করিয়ে-দেওয়া কটাক্ষপাতে, গ্লাস-উপচানো
জলের পিপাসা পাইয়ে দেবার দেহভঙ্গি নিয়ে সে বিপজ্জনক পদবিক্ষেপে এগিয়ে আসত বিহানের
দিকে। কাছে এসে সে অপরূপ তরঙ্গে থমকে দাঁড়াত। চোখ, মুখ, গলা, দেহ সব কিছুর সাহায্যে অনিবার গলায়
বলত -
‘আজ, দুটো সাতের
শেওড়াফুলি লোক্যাল -’
জোরে একটা
ধড়াস শব্দ হয়। শব্দটা শুধু বিহান একাই শুনতে পায়। কারণ শব্দটা হয় তার বুকের গভীরে
কোথাও। তারপর সেই ধড়াস শব্দটার শতশত প্রতিধ্বনি রক্তের ছোটবড় স্রোতের মাধ্যমে
দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে যেতে থাকে বিহানের শরীরের সবকটি কোণায় - আনাচেকানাচে। সে শুধু
উচ্চারণ করে -
‘আচ্ছা। কোন
বগি?’
‘পাঁচের
শেষে - ছয়ের প্রথমে।’
কথা শেষ করে
সুষীম ছন্দে হেঁটে ঘর থেকে ছন্দা চলে যায়। অফিসের হলঘরে তার নিজের চেয়ারে গিয়ে
বসে। ছন্দা একজন সাধারণ করণিক, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। কিন্তু নারী-পুরুষের আকর্ষণ কবেই
বা এইসব অসম পদাধিকার বা অন্য সব বাহ্যিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে? বিশেষত যে
আকর্ষণ তখনও পর্যন্ত আদৌ জৈবিক হবার পথে এগোয়নি।
ছন্দার
কাছেই ক্রমশ বিহান শুনেছে ছন্দার চেনাজানা সমবয়সি মেয়েদের প্রায় সকলেরই বিয়ে হয়ে
গেছে। এমনকি বিয়ের পর তাদের কারো কারো বাচ্ছা-কাচ্চা হয়ে গেছে। কারও
বাচ্চা নার্সারিতে ভর্তিও হয়েছে। ছন্দার বিয়ের বেশ কিছু সম্বন্ধ আনাআনি চললেও এখনও
পর্যন্ত তার কোনোটাই স্থির হয়নি। তাই বিয়েটা ঠিকমতো হয়ে ওঠেনি। অথচ সে একজন
সুশিক্ষিতা সরকারী কর্মচারী। তবে কি ছন্দা তেমন জোরালো সুন্দরী নয়?
নারীর
সৌন্দর্যের যথার্থ সংজ্ঞা কী? সেটা কি শুধু নারীর দেহেই থাকে? নাকি মনেই
থাকে? ঠিক
বুঝে উঠতে পারে না বিহান। তবে ছন্দার চকিত আঁখিপাত, সুপুষ্ট অধরোষ্ঠ, সুমধুর
কণ্ঠস্বর, ঝির
ঝির ঝরে পড়া হাসির শব্দ,
আর বিশেষ করে ছন্দার কবিতাপ্রিয়তা বড় টানে বিহানকে। ছন্দার সাধারণ রূপ তারই দু-একটি গুণের স্পর্শে বিহানের কাছে মধুর হয়ে উঠত।
খুব ধীরে
ধীরে গড়ে ওঠা তাদের দুজনের এই সম্পর্কের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে
এইভাবে বলা যায় যে,
ছন্দা বিহানের সঙ্গে এপর্যন্ত মধ্যমপ্রকার একান্ত সময় কাটিয়ে আসছে। তারা দুজনেই
ভালভাবে জানে কিছু পারিপার্শ্বিক কারণে তাদের বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়।
তবুও ছন্দার
সঙ্গে ওইরকম ‘মধ্যমপ্রকার একান্ত সময়’ কাটানোর ডাকে অবধারিত সাড়া দিতে বিহানের
পাপবোধ হয় না। কেন হয় না কে জানে? ছন্দা সব বারে নিজেই তাকে ডাকে, তাহলে তার
কি পাপবোধ হয়?
নাকি তারও হয় না? পাপ
ব্যাপারটা আসলে কীভাবে নির্ধারিত হয়? পাপের যথাযথ কোনো সংজ্ঞা বা মাপকাঠি
থাকলে সেটা ঠিক কীরকম?
তাহলে পুণ্যের সংজ্ঞাও কি এই একইরকম অবতমস বিবিদিষায় সন্দেহাকীর্ণ?
দুটো সাতের
শেওড়াফুলি লোক্যাল। পাঁচনম্বর বগির একেবারে পিছনের দিকের সারির জানালার ধারের
আগ্রহী সিটে ছন্দা বসেছে। পাশে তার খুব গা ঘেঁষে বিহান বসেছে। কখনও একটু কম গা
ঘেঁষে বসলেই সে ভুরু কুঁচকে বিহানকে বলে - ‘ওভাবে সাতমাইল দূরে বসে আছ কেন? আমি তোমার
কাছে অস্পৃশ্য নাকি?
বিহান তখন সেই কবোষ্ণ কোমল দেহের সঙ্গে লেপটে বসে। তবেই তার বিজয়িনী ঠোঁটে
হাসি ফোটে।’
এইভাবে বসে
ওরা একে অন্যের দেহের উষ্ণতা দিতে নিতে শেওড়াফুলি স্টেশন পর্যন্ত যাবে। তার পর এই
ট্রেনেই ফিরতি যাত্রায় আবার একইভাবে দুজনে অফিসে ঢোকার জন্য হাওড়ায় ফিরে আসবে।
এইরকম গায়ে-গায়ে পাশাপাশি ট্রেনের সিটে বসে পরস্পরের দেহ-গন্ধ বিনিময়কারী
যাওয়া-আসাটাই হচ্ছে ওদের সেই ‘মধ্যমপ্রকার একান্ত সময়’ কাটানো।
দুটো সাতের
শেওড়াফুলি লোক্যালটার সঙ্গে একান্ত যাওয়া-আসার পথে খোলা জানালা দিয়ে ওরা আধুত
চৈত্রের উন্মন বাতাস ডেকে এনে গায়ে মাখে। লাল অথবা কমলা আগুন লাগা উদ্গ্রীব
কৃষ্ণচূড়া দু’জোড়া চোখ দিয়ে আলিঙ্গন করে। পীতভূষণ রাধাচূড়ার অপরূপ রূপ দেখে ওরা
একসঙ্গে বিমোহনে ডুব দেয়।
বিহানের
গায়ে খুব গাঢ় হয়ে বসে থাকা ছন্দার শরীরের সুনিবিড় নারীগন্ধে বিভোর বিহানের উতল
বুকে কত না স্ফুট অথবা অস্ফুট কলরব জাগে। ছন্দা হয়তো সেসব শুনতেই পায় না। সেসময়ে
ছন্দার নিজের ভিতরে কিছু কি হয়? কী হয়? বিহানের মতো কিছু কি হয়? নাকি অন্য কিছু?
ছন্দা
কমলালেবু খেতে খুব ভালবাসে। চৈত্রের কমলালেবু ছোট হয়। টকও হতে পারে। দুটো সাতের
শেওড়াফুলি লোক্যালে কমলালেবুওলাকে দেখতে পেলে ছন্দা তাকে কলরব করে ডাকবেই। কীভাবে
জানে না বিহান,
কমলালেবুর ঝুড়ি থেকে বেছে বেছে ঠিক মিষ্টি লেবুগুলোই ছন্দা বেছে নেয়। আর কিছুতেই
কোনোদিন বিহানকে সে লেবুর দাম দিতে দেয় না। সব বারেই বলে -
‘না-, তুমি দেবে
কেন? আমিই
দেব। আমি তোমাকে খাওয়াব।’
দাম চুকিয়ে
দেবার পর কমলালেবুর কোয়াগুলো নিজেই ছাড়িয়ে আঁশগুলো সযত্নে ফেলে দিয়ে একট্রেন লোকের
জোড়া জোড়া চোখের মধ্যে সে নিজের হাতের চাঁপাকলি আঙুলে ধরে বিহানের মুখে কোয়া তুলে
দিয়ে সত্যিই খাওয়ায় - নিজেও খায়।
ছন্দার বুক
দেখতে বড় নিটোল সুন্দর। বিহানের অসহায় চোখ সেদিকে তাকিয়ে ফেলে। সেসময় জানালা দিয়ে
বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা ছন্দা কীভাবে যেন সেটা ঠিক বুঝতে পারে।
তখন ওর দিকে থাকা বিহানের হাতটা ছন্দা তার শাড়ির আঁচলের আড়াল করে টেনে নিয়ে ওর
গাবলুগুবলু নরম বুকের নীচের দিকটাতে ছোঁয়ায়, চেপে ধরেই থাকে।
বিহানের
নিতান্ত বোকাটে অপদার্থ হাত সেসময় উপযুক্ত গন্তব্যে গিয়ে ঘুরে দেখার জন্য
বাসনাচঞ্চল হয়ে ওঠার বদলে প্রায় অবশ আর সমর্পিত হয়ে পড়ে। তখনও ছন্দাকে শারীরিকভাবে
পাবার কোনোরকম ইচ্ছা বিহানকে দখল করে বসেনি। কারণ তখনও ঠিকমতো সে বুঝে উঠতে পারেনি
ছন্দার বুক ভালবাসার সুরভিতে পূর্ণ, নাকি শুধুই মাংসের গন্ধে ক্লিন্ন?
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment