ধারাবাহিক
গল্প
তুষার সরদার
দুটো
সাতের শেওড়াফুলি লোক্যাল
[৩য় পর্ব]
"ধুস্! কী যে সব অদ্ভুত আর আজগুবি কথা বলো না তুমি, তার কোনো মাথামুণ্ডুই নেই। তুমি নিজের চোখেই তো দেখলে গো, আমার কত্তো বেশি লেট-ম্যারেজ হল। যতদিন সেটা না হচ্ছিল ততদিন আমার টাইম-পাস করাটাও তো যথেষ্ট জরুরি ছিল না কি?"
পূর্বানুবৃত্তি ছন্দা ও বিহান
নিয়মিত লোক্যাল ট্রেনে অফিসে যাতায়াতের মাঝে সুযোগমতো নির্জন মালিয়া স্টেশনে বসে অনেকক্ষণ
সময় কাটিয়েছিল। ছন্দা জানাল বিহানই ছন্দার নারীজীবনের প্রথম পুরুষ। গায়ের চাদরটা ভাল
করে জড়িয়ে নিয়ে বিহানের হাতটা ধরে চাদরের তলা দিয়ে নিজের বুকে ঘনিষ্ঠভাবে নিল। তারপর…
-এবার একটা দারুণ মজার কথা তোমায় বলি শোনো। আমি যে স্টেশনে নামি তার কাছে বেশ কয়েকটা নানারকম দোকান আছে। পান বিড়ি বা চা-দোকান, তেলেভাজা এইসব আর কী। সবই আমার চেনা। ওদের মধ্যে কয়েকটা দোকানের জন্য কিছু মালপত্র কিনতে কয়েকটা বারো-তেরোর বাচ্চাছেলে সপ্তাহে দু-তিনদিন শেওড়াফুলি আসে-যায়। রোজ যাওয়া-আসা করি বলে ওরা আমাকে ভালভাবেই চেনে। মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে ওদের কথাও হয়। ওদের মধ্যে জনাতিনেক একদিন বা আরও বেশিদিন হতে পারে আমাদের শেওড়াফুলি লোকালে বসে থাকতে দেখেছে। আমি সেদিন স্টেশনে নামতে আমায় দেখতে পেয়েই ওরা এসে আমাকে বলে কী জানো? বলে কী না,
-আন্টি লোক্যাল ট্রেনে তোমার পাশে বসা তোমার বরটাকে দেখলাম গো। কী সুন্দর দেখতে বরটা গো
তোমার! খুব ভাল বর হয়েছে! তোমাকে খুব আদরে যত্নে রাখবে দেখো।
-হি হি, আমার বিয়ের
আগেই ওরা আমার বরটাকে দেখে নিল, হি হি... তা হ্যাঁ গো আমার বরমশাই, বিয়ের পর
আমাকে খুব আদরে যত্নে সত্যি রাখবে তো!
বোধহয় আরও
মাসখানেক পরে এক সুনির্দিষ্ট দিনে ছন্দার সেই ‘বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে বিয়েটা’ হয়ে
গেল। অফিসের প্রায় সব সহকর্মী আর পদাধিকারীকে তার বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিল ছন্দা।
সেটাই স্বাভাবিক ছিল। অবশ্য সে বিয়েতে বিহান যায়নি। কারণ ছন্দা বিশেষভাবে চেয়েছিল
তার ওই ‘লোক দেখানো বিয়েটা’তে বিহান যেন না যায়। প্রসঙ্গত বিহান নিজেও মোটেই
আগ্রহী ছিল না সেখানে ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে। কিন্তু খুব অকারণে সেদিন অবোধ্য
কষ্টের দল এসে তাকে ঘিরে ধরে থাকল।
বিয়ের পর
থেকে ছন্দা অফিসে আসছিল না। বিহান ভাবল, কোনো বিয়ের লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান শেষ
হতে মোটামুটি দিন দশেক ছুটি তো লাগেই। কিন্তু বিয়ের পর দশ দিন ছাড়িয়ে পনেরো দিন
পেরিয়ে গেলেও ছন্দা অফিসে জয়েন করল না। তার পর ছন্দার সহকর্মীদের মুখে শোনা
গিয়েছিল ছন্দা তার ‘নকল’ বরের সঙ্গে বেশি ভিড়ের বিশ্রী জায়গা সেই পুরীতেই আসল ও
লম্বা হানিমুনে গেছে। দীর্ঘ হানিমুন সেরেটেরে পুরী থেকে বাড়িতে ফিরে এসে আরও কতদিন
সে ছুটিতে কাটাল। তার পর প্রায় দুমাস পরে একদিন বিয়ের শাড়ি-গয়নাসমেত অফিসের কাজে
অনেকরকম সুখ মাখা অবস্থায় অফিসে জয়েন করল ছন্দা।
‘নকল’ বরের
সঙ্গে আসল হানিমুনের সময় বিভিন্ন জায়গায় নানা বিচিত্র আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে তোলা
দুজনের অগুনতি ঘনিষ্ঠ প্রফুল্ল ফোটো ছন্দা দেখাল
সহকর্মীদের। যথোচিত সলজ্জ হাসিসহ সে এও জানিয়েছিল যে আরও বেশ কয়েকটা ফোটো আছে
তাদের হানিমুনের,
কিন্তু সেই ফোটোগুলো অন্যদের দেখান যাবে না। এইসব কথা ছন্দার সহকর্মীদের
মাধ্যমে বিহানের কানে এসেছিল।
যথেষ্ট
উদারতা ও খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের পরিচয় দিয়ে পরদিন বিকেলের দিকে বিহানের চেম্বারে
গিয়ে সৌজন্যমূলক সাক্ষাতের একফাঁকে ছন্দা জানাল, যেহেতু বিহান বিয়ের সময় উপস্থিত ছিল
না, সেজন্য
তাদের বিয়ের সময়কার এবং হানিমুনের ফোটোগুলো সে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। বিহান ইচ্ছা করলে
সেগুলো দেখতে পারে...। বিহান তখন সত্যিই
কাজে বিশেষ ব্যস্ত ছিল। তাই তার পক্ষে সেসব দেখা সম্ভব হল না। বিয়ে, বাসর, ফুলশয্যা
এবং প্রলম্বিত মধুচন্দ্রিমার স্মরণীয় সমুল্লাস মুহূর্তদের বন্দি করা অবস্থায় সঙ্গে
নিয়ে এক পুলকিত হংসী হলঘরে নিজের টেবিলে ফিরে গেল।
দুটো সাতের
শেওড়াফুলি লোক্যালটা এখন ওদের ছাড়া একা-একাই বিষণ্ণ মনে
যাওয়া-আসা করে। কারণ আগের মতো ওই শেওড়াফুলি লোক্যালে একসঙ্গে সময় কাটাতে যাবার কথা
আর তোলেই না ছন্দা। তাই তাদের যাওয়াও হয় না। আগে ছন্দাই দুটো সাতের শেওড়াফুলি
লোক্যালটার সঙ্গে দুজনে যাবার জন্য বিহানের কাছে বায়না করত। বেশ কয়েকদিন পর বিহান
নিজেই এক ফাঁকে ফোনে ছন্দাকে বলল,
-তুমি যে গোপালপুর-অন-সী যাবার কথা বলেছিলে, আমার মনে হয়
সেই ব্যাপারটা বরাবরের মতো বাদ দেওয়া উচিত।
-তুমি একদম ঠিক বলেছ গো! তুমি কী ভাল!
-ফোনের
ওপারে খুব হাসিখুশি গলা শোনা যায় ছন্দার,
-অবশ্য
তোমার ইচ্ছা না থাকলেও আমার এখনও কিন্তু গোপালপুরে যাবার ভীষণ ইচ্ছা আছে। কিন্তু
আমার হাজার ইচ্ছা থাকলেও এখন আর গোপালপুর-অন-সী যাওয়াই যাবে না। অবশ্য শুধু
গোপালপুর বা বলি কেন,
আমার তো এখন কোত্থাও যাওয়া একেবারেই বারণ! তোমার সঙ্গে একটা একদিনের খুব
শর্টজার্নি যে করে আসব তারও কোনও উপায় নেই। লং ট্রেন-জার্নি বা অন্য কোনো রকমের
জার্নিও আমার একদম চলবে না। এটা প্রথম মাস তো! তাই খুব সাবধানে থাকা উচিত। অবশ্য
আমার গাইনির ডাক্তার বলে দিয়েছে শুধু একমাস বা দুমাস নয়, পুরো দশটা
মাসই আমাকে খুব সাবধানে থাকতেই হবে।
-এই সুখবরের জন্য অভিনন্দন! উইশ ইয়্যু সেফ ডেলিভারি। আচ্ছা, তোমাকে
একটা কথা তাহলে জিজ্ঞেস করি, তুমি দুটো সাতের শেওড়াফুলি লোক্যালে বসে যেসব কথা আগে আমাকে
বলতে বা বলেছিলে—
-ধুস্! কী যে সব অদ্ভুত আর আজগুবি কথা বলো না তুমি, তার কোনো মাথামুণ্ডুই নেই। তুমি নিজের চোখেই তো দেখলে গো, আমার কত্তো বেশি লেট-ম্যারেজ হল।
যতদিন সেটা না হচ্ছিল ততদিন আমার টাইম-পাস করাটাও তো যথেষ্ট জরুরি ছিল না কি? আর এই
নিতান্ত সাধারণ ব্যাপারটাকে তুমি কিনা নেহাতই বোকার মতো এতটা সিরিয়াসলি... আচ্ছা, তোমার কি
হিউম্যান ফিলিংস বলে একেবারে কিছুই নেই!
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment