ধারাবাহিক
গল্প
ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য
পিছুটান রয়ে যায়
[পর্ব – ২]
ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য
পিছুটান রয়ে যায়
[পর্ব – ২]
"এরপর হয়তো ছেলের ইংলিশের টিচারের প্রয়োজন পড়বে। আমার মনে হয় তোমার চেয়ে ত্রিদিব ওই সাবজেক্টটা বেটার জানে। শহরের ভাল ছেলেমেয়েরা সবাই পড়তে চায় তার কাছে। আগে থেকে নাম লেখায়। তোমার তো সেসবের ঝামেলা নেই। ত্রিদিবকে একবার ইশারা করলেই...।"
পূর্বানুবৃত্তি দুবছর আগে স্বামী যদুর অকারণ সন্দেহের বিষের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে স্বামীর ঘর ছেড়েছে কণিকা। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় মোটর সাইকেল ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় মেয়েকে। চোট লাগে মায়ের। পাশের বাড়ির গণেশ জানতে পেরে মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে নিয়ে আসে। তারপর…
মাটির
দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কত কথা ভাবতে থাকে কণিকা। আনমনে হাত
যায় কপালে। এখনো ফুলে রয়েছে কপালটা। "মা ভাত দাও।" মেয়েটা ডাকে
বাড়ির ভিতর থেকে। দুয়ারে আসে কণিকা।
সেইসময়
বাড়ি ফেরে যদু। সদর দরজার সামনে সিঁদুর পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয় মনে।
"দরজার বাইরে সিঁদুর পড়ে কেন?" জিজ্ঞাসা করে। সুর সপ্তমে, বিস্ফারিত
দুই চোখে আগুন জ্বলে। কাঁচুমাচু হয়ে কণিকা বলে, "ও বাড়ির
কাকিমা এসেছিল। সিঁদুর পড়িয়ে...।"
বারুদে আগুন লাগে, দপ করে জ্বলে ওঠে যদু। চিৎকার করে বলে, "ওহ্ বিবাহবার্ষিকী হচ্ছে। তা কাকিমার থেকে সিঁদুর না পড়ে এক্কেবারে কাকিমার ছেলের হাতে পড়লেই হয়, তারও বউ ভেগেছে। এইবার থেকে গণেশকেই না হয় স্বামী বলে ডাকিস। দূর হ্ বজ্জাত চরিত্রহীন মেয়েছেলে।" চুলের মুঠি ধরে টেনে হিড়হিড় করে কণিকাকে বাড়ির বাইরে করে দেয় যদু। ভীষন অভিমানে ঘর ছাড়ে কণিকা। এ অপমান অসহনীয়।
মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়ি আসে কণিকা। বাপ-মা চলে গেছে কবেই। দাদা-বৌদির সংসার। অভাবের টুংটাং শব্দ অবিরত। সেখানে হাত-পা গুটিয়ে কদিন বা বসে থাকা চলে। কাজের খোঁজ করে কণিকা। জুটেও যায়। তবে দিনরাত সে বাড়িতেই থাকতে হবে। এমন শর্তে খুশি হয় কণিকা।
শহরের বুকে ছোট্ট ছিমছাম ফ্ল্যাট। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকে দিদিমণি। ছেলে ফাইভে পড়ে। সন্ধ্যাবেলায় ছেলের পড়া শেষ হলে কণিকার জীবনের কথা শোনে দিদিমণি। যদুর অহেতুক সন্দেহের কথা বলে চোখের জল ফেলে কণিকা। মৃদু হাসি মুখে ধরে রেখে চুপ থাকে দিদিমণি। যেন কণিকার স্বামীর বিশেষ কোনো দোষ নেই দিদিমণির চোখে। খারাপ লাগে কণিকার। ভাবে সত্যি ছোট মানুষের দুঃখ স্পর্শ করে না দিদিমনিদের মতো মানুষকে, নিজের কথা না শোনালেও হোতো। ভুল ভাঙে কণিকার, পরে।
দিদিমণির স্বামী চাকরি করে দূরে। সপ্তাহ শেষে এখানে আসে। একটা রাত কাটিয়ে ফিরে যায় আবার। সেদিন দাদাবাবু বাড়িতেই ছিল। দিদিমণির ছেলেকে পড়াতে এসেছে মাস্টারমশাই, সেদিনই প্রথম। এতদিন ছেলেকে নিজেই পড়াত দিদিমণি। অংকটা আর আয়ত্তে নেই তাই টিউশন দেওয়া। মাস্টারমশাই পড়াচ্ছে। কিচেনে ব্যস্ত ছিল কণিকা। দিদিমণি আর দাদাবাবু রয়েছে কিচেনের ঠিক পাশের ঘরে। দু জনের কথা কণিকার কানে আসে স্পষ্ট ভাবে।
"এই মাস্টারমশাইয়ের সন্ধান পেলে কীভাবে?" জিজ্ঞাসা করে দাদাবাবু। "আমাদের স্কুলের ত্রিদিবের মেয়েকে পড়ায়। ভীষণ ভাল টিচার, ত্রিদিবই জোর করে...।" বলে দিদিমণি। "ত্রিদিব যে তোমার স্কুলের সে-কথা নতুন করে নাই-বা বললে।" বলে বেশ কিছক্ষণ চুপ থাকে দাদাবাবু। সাপের হাঁচি বেদেয় বোঝে। দাদাবাবুর কথা বলার ধরন শুনেই হাতের কাজ থমকে এসেছে কণিকার। ক্ষণিকের নীরবতা নেমে আসে পাশের ঘরে।
"ত্রিদিব বলল তাই অঙ্কের মাস্টার দিতে হলো! তুমি পারছিলে না? তাইতো...।" দাদাবাবুর কথাগুলো শুনতে পায় কণিকা। দিদিমণির কোনো সাড়াশব্দ পায় না। হয়তো অবাক হয়ে চেয়ে আছে স্বামীর দিকে। অন্তত তাই থাকা উচিত বলে মনে হয় এই মুহূর্তে। এমন ঘোলাটে মেঘ আকাশে আগে দেখেছে কণিকা, নিজের জীবনে বারবার এসেছে এমন মুহূর্ত।
"এরপর হয়তো ছেলের ইংলিশের টিচারের প্রয়োজন পড়বে। আমার মনে হয় তোমার চেয়ে ত্রিদিব ওই সাবজেক্টটা বেটার জানে। শহরের ভাল ছেলেমেয়েরা সবাই পড়তে চায় তার কাছে। আগে থেকে নাম লেখায়। তোমার তো সেসবের ঝামেলা নেই। ত্রিদিবকে একবার ইশারা করলেই...।" কথা শেষ করে না দাদাবাবু। কণিকা বুঝে যায় সবটা। অন্তত ত্রিদিব কীভাবে এই বাড়ির বাতাসে মিশে রয়েছে সে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এক টুকরো আগুনে মেঘ কণিকার চোখের সামনে ভেসে আসে।
"তুমি এইভাবে কথা বলছ কেন? আজ সাত-আট মাস ধরে তুমি..." দিদিমণির কথাগুলো কণিকার নিজের গলার প্রতিধ্বনি বলেই মনে হয়। "কেন বলছি তুমি ভালই জানো। স্মার্ট, ভাল কথা বলতে পারে, দেখতে ভাল, পরোপকারী, স্কুলের সবাই ভালবাসে ত্রিদিবকে এই সব শুনে শুনে আমি...।" "সেসব তো মিথ্যে নয়। যার যে গুণ আছে সেটা অস্বীকার করি কীভাবে বলো। তবে আমি আগেও তোমাকে পরিষ্কার করে বলেছি আমার কোনোরকম...।" দিদিমণির শেষের কথাগুলো কেমন যেন আর্তির মতো শোনায়। "আমাকে বোঝাতে এসো না।" দাদাবাবুর সামান্য উঁচু গলার কথা শুনে মনে হয় যদু পাশের ঘরে বকাঝকা করছে কণিকাকে, শুধু রোজদিনের খেউড়গুলো বলতে ভুলে গেছে বুঝি।
যদুর সন্দেহবাতিকতার কথা শুনে দিদিমণির সেদিনের স্মিত হাসির কারণ বুঝতে পারে কণিকা। এরপর থেকে চোখ কান খোলা রেখেছে কণিকা। দিদিমণি আর দাদাবাবুর এক ছাদের নীচে জীবনের তাল-ছন্দ কেমন যেন চেনা মনে হয়েছে, শুধু সুরের ওঠাপড়ায় তফাৎ রয়েছে সামান্য। তবে অবাক হবার আরো কিছু বাকি ছিল বৈকি।
ক্রমশ…
No comments:
Post a Comment