বাতায়ন/মাসিক/ছোটগল্প/২য় বর্ষ/২৮তম সংখ্যা/২রা
ফাল্গুন, ১৪৩১
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সংখ্যা | ছোটগল্প
ডরোথী
ভট্টাচার্য
মমি
"রাজা কয়েকহাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে, তাকে দেখতে কত লোক দূর দূর থেকে ছুটে আসে কিন্তু আমি তো বেঁচেই মমি হয়ে আছি, আমাকে খুঁজতে কেউ আর আসে না।"
ক্রুজের
ডেকের উপর দাঁড়িয়ে শ্বেতা। নীল নদের উপর ভাসমান ক্রুজ। দূরে ভেসে চলেছ অনেকগুলো
পাল তোলা ফেলুকা। নানা রঙের পোশাক পরা মানুষ তাতে বসে রয়েছে। নীলের উপর দিয়ে
উড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য গাঙচিল। দুপাশে ব্যস্ত জনপদ, অসংখ্য মানুষ আর
গাড়ি, যার
যার কাজে ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত,
তারই মাঝে
প্যাপাইরাসের সারি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ভ্যালি অফ কি্সের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।
গাড়ি এসে
থামল। সবাই সিটে এসে বসার পর গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি ছুটে চলেছে। বিস্তীর্ণ
অঞ্চল, ধু-ধু করছে বালি। কয়েক ঘণ্টা ছোটার পর গাড়ি এসে দাঁড়াল ভ্যালি অফ কি্সে। মিশরের পশ্চিম প্রান্ত। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত পূর্ব দিক জীবনের প্রতীক, আর পশ্চিম
দিক মৃত্যুর প্রতীক,
তাই ফ্যারাওরা এখানেই গড়ে তুলেছিল তাদের সমাধি সৌধ। পাহাড় খুঁড়ে খুঁড়ে
নীচে মাটির গভীরে তাদের শবদেহ মমি করে রাখা হত।
শ্বেতা
কয়েকজনের সমাধিক্ষেত্র ঘুরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল তুতেনখামেনের সমাধিক্ষেত্রের
পাশে। এই সেই ফ্যারাও যার জীবন মাত্র আঠেরোটা বসন্ত পার হয়ে এসে থমকে
দাঁড়িয়েছিল। শ্বেতার মন ভীষণ অনুভূতিপ্রবণ। এই সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে
থাকা ফ্যারাওয়ের কথা ভেবে তার চোখে জল এল। তার মাথার চুল, মুখাবয়ব এমনকি
পায়ের পাতাদুটো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাইরের কলকোলাহল এখানে এসে যেন স্তব্ধ
হয়ে গিয়েছে।
সিঁড়ি
দিয়ে নামতে নামতে চোখে পড়ল দুদিকে পাথরের বুকে কুঁদে কুঁদে গড়ে তোলা তখনকার
শিল্পীদের অসামান্য কারুকার্য, স্বর্ণখচিত কফিন আরো অনেক কিছু। শ্বেতার মনে হল, এইসব
শিল্পীদের নাম কোথাও লেখা হয় না, কালের অতল গর্ভে তাদের নাম হারিয়ে যায়, বেঁচে থাকে
তাদের সৃষ্টি যা সমকালকে ছাপিয়ে যায়।
গাড়ি ধরার
ঠিক আগের মুহূর্তে চোখে পড়ল লাঠি হাতে এক অস্থিচর্মসার বৃদ্ধা এগিয়ে আসছে। সামনে
এসে পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞাসা করল "তোমরা কি ইণ্ডিয়া থেকে আসছ?" থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, "হ্যাঁ, কেন?" "আজ থেকে পঞ্চাশ
বছর আগে আমার স্বামী আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল, বলেছিল, এখানে কাজের
জন্য আসছে। আমাকে এক জায়গায় অপেক্ষা করতে বলে সেই যে চলে গেল আজ অবধি তার দেখা
পেলাম না। আমি গ্রামের মেয়ে, নতুন বিয়ে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ির লোকদের নাম-ঠিকানা কিছুই কাউকে ঠিক করে বলতে পারিনি। তাই দেশে আমার আর যাওয়া হলো না, স্বামীর দেখাও
আর পেলাম না। এইখানে যে রাজা কয়েকহাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে, তাকে দেখতে
কত লোক দূর দূর থেকে ছুটে আসে কিন্তু আমি তো বেঁচেই মমি হয়ে আছি, আমাকে
খুঁজতে কেউ আর আসে না। কাছেই এক হোটেলের মালকিনের দয়ায় এঁটো থালাবাসন ধুয়ে আর
কিছু লোকের বাড়ি কাজ করে কোনরকমে দিন কাটাচ্ছি। কী নিদারুণ
প্রতারণা! পঞ্চাশ বছর আগে এক কিশোরী বধূকে নতুন কাজ পাওয়া
আর ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়ে তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেল তার স্বামী।
আমাদের
গাড়ি যাত্রীদের ওঠার জন্য হর্ন মারতে লাগল। সব যাত্রীরা এক
এক করে এসে জড়ো হলো। উপায় নেই, আজ রাতেই
প্লেন ধরার তাড়া আছে। মনে হল, এই চলমান পৃথিবীতে কারোর জন্য যেন কিছু ভাবারও সময়
নেই। গাড়ি ছেড়ে দিল,
দূর থেকে এখনও দেখা যাচ্ছে কোটরে ঢোকা চোখ নিয়ে হাতে লাঠি নিয়ে সেই জীবন্ত মমি এক জায়গায় স্থাণুর মতো বসে রয়েছে।
গাড়ি
এগিয়ে চলেছে।
সমাপ্ত
ভালো লাগল।
ReplyDelete