বাতায়ন/তৈমুর
খান সংখ্যা/প্রবন্ধ/৩য় বর্ষ/৩২তম সংখ্যা/১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
তৈমুর
খান সংখ্যা | প্রবন্ধ
হিমাদ্রি
শেখর দাস
কবিতা
ও ছন্দের মেলবন্ধন
"রবীন্দ্রনাথ ছন্দ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ছন্দ কেবল বাইরে বাঁধন, অন্তরে মুক্তি। অর্থাৎ কথাকে তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার নামই ছন্দ।’ ছন্দ কেমন? এর ব্যবহার কীরূপ?"
প্রখ্যাত ছান্দসিক
প্রবোধচন্দ্র সেন বলেছেন, ‘শিল্পিত বাকরীতির
নামই ছন্দ।’ এভাবে কবিতায় ছন্দ ব্যবহারের মাধ্যমে কবিতায় গতিসৌন্দর্য বা
ধ্বনিসৌন্দর্য সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কবিতার বিশেষত্ব হচ্ছে তার গতিশীলতা।’ এ গতিশীলতার জন্য
কবিতায় ছন্দ ব্যবহার তার পরিস্ফুটনের বাহন রূপে কাজ করে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তার
কবি জীবনের ঊষালগ্ন কালেই বলেছিলেন, ‘অনুভবের ভাষা
ছন্দোবদ্ধ। কেননা কবিতা কিছু বলে না, বেজে ওঠে।’ এই বোধ
তার মধ্যে জাগ্রত হয়ে ওঠেছিল বহু আগেই। মূলত,
কবিতার
জন্মমুহূর্তেই নির্ণীত হয়ে যায় যে, কবিতাটি কোন ছন্দে
লেখা হবে। রবীন্দ্রনাথ এটাও বলেছেন, কবিতার ছন্দ যে-নিয়মে
উৎপন্ন হয়েছে, বিশ্বজগতের সমস্ত সৌন্দর্যই
সে নিয়মে সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া ছন্দ হচ্ছে স্মৃতিসহায়ক। ফরাসি কবি লুই আরাগাঁ
বলেছিলেন, কবিতার ইতিহাস তার টেকনিকের
ইতিহাস। ছন্দ ব্যবহারে আমাদের এ টেকনিকের ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি করে জেনে রাখা
প্রয়োজন। এখানে বলে রাখা দরকার, ছন্দের জন্য তার চাল
বা চরিত্র জানা থাকা চাই। এ জন্য অক্ষর বা মাত্রা সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন
আগেই বলেছি। কেনো না অক্ষর বা সিলেবল এবং মাত্রা হলো বাংলা ছন্দের মূলভিত্তি।
অক্ষর বা সিলেবল হলো দুই প্রকার মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর। কিন্তু, অক্ষর বা সিলেবল বুঝতে হলে বর্ণ বা ধ্বনির তফাতটা বুঝতে
হবে। কেননা, অক্ষর বা সিলেবল হবে আমরা
যেভাবে শব্দ উচ্চারণ করি সেই অনুযায়ী,
যেভাবে
লিখি সেভাবে নয়। আর মাত্রা হলো, অক্ষর বা সিলেবলের
উচ্চারণের কাল বা সময় জ্ঞানকে মাত্রা বলে। অর্থাৎ এক-একটা অক্ষর বা সিলেবলকে
কতক্ষণ ধরে উচ্চারণ করা হচ্ছে তার পরিমাপকই হচ্ছে মাত্রা।
রবীন্দ্রনাথ ছন্দ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ছন্দ কেবল বাইরে বাঁধন, অন্তরে মুক্তি। অর্থাৎ কথাকে তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার নামই ছন্দ।’ ছন্দ
কেমন? এর ব্যবহার কীরূপ? প্রশ্ন আসতে পারে। এ প্রশ্নের কিছুটা সমাধানের জন্য হলেও
জানা প্রয়োজন ছন্দ বিশ্লেষণ। ছন্দ বিশ্লেষণ করতে হলে ছন্দের কতগুলো উপাদান বা
বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হয়। সাধারণত বাংলা ছন্দে অক্ষর মানে অক্ষর জ্ঞান, মাত্রা মানে মাত্রা নির্ধারণ পদ্ধতি, যতি বা ছেদ-এর ব্যবহার, পর্ব বা পর্বাঙ্গ বিন্যাস, পঙ্ক্তি, চরণ এবং স্তবকের আঙ্গিক গঠন। এই কয়েকটি উপাদান বা বিষয় সম্পর্কে
বিশদভাবে জেনে ছন্দলিপি নির্ণয় করা হয়ে থাকে বলে তা জেনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। তা
ছাড়া, এগুলোর মধ্যে অক্ষর এবং
মাত্রা হচ্ছে ছন্দের মূল উপাদান। কবিতার সৌন্দর্যকে জীবন্ত করে তুলতে ছন্দ এক
অত্যাবশ্যক উপাদান। শব্দ, মন্থন, পলক সবই ছন্দের ছাপ রেখে যায় পাঠকের মননে। তবে ছন্দ—
অদ্বিতীয় ধারা নয়। তা বিবর্তিত হয়, পরিবর্তিত হয়, নতুন নতুন রূপ নেয়। অতীতে বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ছন্দের ধরণ
পরিবর্তন হয়েছে। আজ কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ছন্দের বিবর্তনকে বুঝে নেওয়া
গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শুধু শৈলরূপ বা
পদ্ধতির পরিবর্তন নয়—ছন্দের বিবর্তন কবিতার ভাবপ্রকাশ, ভাষাগত সম্ভাবনা ও অনুভূতির স্বীকৃতি।
এই প্রবন্ধে প্রথমে ছন্দের
ধারণা ও শ্রেণিভেদ দেখব, তারপর বাংলা (এবং
সংক্ষিপ্ত হিসাবে বিশ্ব) কাব্যচর্চায় ছন্দের ইতিহাস ও ধারা নিরীক্ষণ করব, এবং অবশেষে বিবর্তনের কারণ, নতুন ছন্দের উদ্ভব ও বর্তমান চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করব।
আদিতে ‘ছন্দ’ বলতে শব্দ বা
পদ্যকে একটি নিয়মিত প্রতিরূপে গোষ্ঠীবদ্ধ করা — অর্থাৎ, যে ধ্রুব গতি, যে নিয়মিত
পুনরাবৃত্তি (মাত্রা, স্বর, যতি, তান ইত্যাদি) — তাকে
ছন্দ বলা হয়। ছন্দ শুধু মাত্র ‘অঙ্কের নিয়ম’ নয়, এটি ধ্বনিগত, বায়ুব্যয়
(শ্বাস-উচ্চারণ), উচ্চারণগত গতি ও
ধৈর্য, ভাব ও সুরের সমন্বয়। একাদিক
ভাষাতত্ত্বে ছন্দকে ‘এক ধরণের পুনরাবৃত্তিমূলক গতি’ হিসেবে ধরা হয় — বিশেষমাত্রা ও
বেগের গতি ছন্দকে গঠন করে। কবিতাকে শুধু তথ্যবহুল লেখা নয়, রূপমূলক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ছন্দ কাজ করে — তা
পাঠকের মস্তিষ্কে স্পন্দন সৃষ্টি করে,
ছন্দস্বরূপ
অনুভূতির সঞ্চার ঘটায়।
ছন্দ গঠনে যে উপাদানগুলির
ভূমিকা থাকে, সেসব প্রধানাংশ নিম্নরূপ—
মাত্রা (Metre / মাপ) — প্রতিটি পদের ধ্বনিসংখ্যা বা ধ্বনিমাত্রার
সীমা। (যেমন ৪ মাত্রা, ৮ মাত্রা ইত্যাদি)
যতি (Foot / পাদ) — প্রতি চরণ বা প্রতি পঙ্ক্তিতে যে ধরণের
ধ্বনির বিন্যাস থাকে।
তান (Elongation / দীর্ঘতা) — ধ্বনির প্রসার, দীর্ঘ বা স্বল্প উচ্চারণ।
যতি সম্ভাব্যতা ও যতি
পরিমার্জন — কখন ধ্বনিকে ভাগ করা হবে বা মিলিত করা হবে।
উচ্চারণ ভঙ্গি (Accent / stress), চলমান গতি ও শ্বাস-উচ্চারণ —
ধ্বনির বেদী, উচ্চারণে গতি ও স্বরোপযোগ।
অনুপ্রাস, অলংকার ছন্দ সংযোগ — ধ্বনির পুনরাবৃত্তি, রস ও সাদৃশ্য।
এই উপাদানগুলিকে
কবি–ব্যবহারিক সচেতনতা, অনুভূতির গতি ও
ভাষাগত প্রবণতা মিলিতভাবে রূপায়ন করে ছন্দ সৃষ্টি। ছন্দ কবিতাকে সংগঠিত করে, এটিকে পাঠযোগ্য ও শ্রুতিমধুর করে তোলে। ছন্দ:
শব্দের স্বরবিভাজন ও
ধ্বনিসাম্য তৈরি করে। কবিতার গতি ও তালের অনুভূতি দেয়। অনুভূতির প্রবণতা
(উচ্চ-নিম্ন, স্থিতি-চলন) নির্দেশ করে।
পাঠককে আবেগের ছন্দস্বরূপ প্রবেশ করতে সহায়তা করে। সাহিত্যিক নিয়ম ও সৃজনশীলতাতেও
পথ প্রস্তুত করে। তবে এর সীমাবদ্ধতা আছে — কখনও ছন্দ বেশি জটিল হলে ভাবপ্রকাশ
বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে।
বাংলা ভাষা ও বাংলা কবিতার
ক্ষেত্রে ছন্দের বিবর্তন একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। বাংলা ছন্দচর্চা সাধারণত
তিনটি প্রধান বিভাগে ভাবা হয় — মাত্রাবৃত্ত,
স্বরবৃত্ত
ও অক্ষরবৃত্ত।
ইতিহাস অনুসারে, ছন্দচর্চার সূত্রীকালে সংস্কৃত ও প্রাকৃত ছন্দবিশ্লেষণ
বাংলা ভাষাকে প্রভাবিত করে। বাংলা ভাষা যখন সদ্য কবিতার পথ ধরেছিল, তখন ভাষার নিজস্ব উচ্চারণ, শব্দরূপ ও কলসামঞ্জস্য নির্দিষ্ট ছন্দরূপ আবেদন দিয়েছিল।
চর্যাপদ-এর সময়েই বাংলা
কাব্যশ্রেণি ছন্দ ব্যবহার শুরু করে — চর্যাপদে “মাত্রাবৃত্ত” ছন্দের ধরণ নজর আসে।
যদি প্রকাশ প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়, চর্যাপদে কয়েক
মাত্রার ধরণের ছন্দ (চারমাত্রা, পাঁচমাত্রা) ব্যবহৃত
হয়েছে বলে দেখা যায়। তারপরে ব্রজভাষার বৈষ্ণব পদাবলী ও ভক্তিকাব্যে ছন্দচর্চা আরও
সমৃদ্ধ হয়। ব্রজ পদাবলীতে ছন্দ-সংস্কৃতির বহুবিধ প্রয়োগ ও ছন্দ-বৈচিত্র্য দেখা
যায়।
মধ্যযুগে বাংলা কাব্যের
ছন্দচর্চা ছিল বেশ সংহত ও ছন্দনির্ভর। ‘পয়ার’ ছন্দ ছিল প্রধান একটি ধারা, যা ৮/৬ মাত্রার গঠন প্রধানতা পায়। পয়ার ছন্দে পাঠ সুরময়তা ও
গম্ভীরতা বজায় রাখতে সক্ষম। ছাপরো ছন্দ,
মহাপয়ার, ভঙ্গপয়ার ইত্যাদি ছন্দরূপও মধ্যযুগে পরিলক্ষিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, মহাপয়ার হ’ল পয়ার ছন্দের একটি
বিস্তৃত রূপ, যেখানে আট/দশ মাত্রার গঠন
দেখা যায়। এই যুগে ছন্দ ছিল গদ্যাভিনয় ও সুরময় অভিজ্ঞতার ধারা, যেখানে ছন্দ ও সুর একসাথে মিলিত ছিল।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে
অক্ষরমাত্রিক, বর্ণমাত্রিক, সংকোচপ্রধান, মিশ্র-প্রকৃতিক ছন্দ
বলা হয়ে থাকে। বাংলা কবিতার আদিতম ও প্রধানতম ছন্দ হচ্ছে অক্ষরবৃত্ত। বাংলা ছন্দের
ভিত্তিই হলো অক্ষরবৃত্ত। যা কথা বলার বা প্রাণের মৌলিক ছন্দ। দেখা গেছে যে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অধিকাংশ কবিতাই লেখা হয়েছে
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে প্রবোধচন্দ্র সেন পরবর্তী সময়ে নাম
দিয়েছিলেন কলাবৃত্ত ছন্দ। অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় নাম দিয়েছেন ধ্বনিপ্রধান।
রবীন্দ্রনাথ নামকরণ করেছিলেন সংস্কৃত ভাঙা ছন্দ বা ব্রজবুলি-ভাঙা। মূলত, রবীন্দ্রনাথই মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রকৃত প্রবর্তক।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘মানসী’ কাব্যে এ ছন্দের প্রয়োগ করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ নাম
দিয়েছিলেন হৃদ্যা। সুধীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছিলেন মাত্রিক। কালিদাস রায় নাম দিয়েছিলেন
স্বরমাত্রিক। এ ছাড়া একে বিস্তারপ্রধান ও ধ্বনিমাত্রিক ছন্দ বলা হয়ে থাকে। আর
স্বরবৃত্ত ছন্দকে প্রবোধচন্দ্র সেন আরেকটি নাম দিয়েছিলেন দলবৃত্ত ছন্দ।
১৮–১৯ শতকে বাংলা সাহিত্যে
একটি নতুন ধারা শুরু হয় — ছন্দবিচ্যুতি,
অমিত্রাক্ষর
ছন্দ ও মেট্রিক বিভাজন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন।
অমিত্রাক্ষর ছন্দ ছেদ স্থাপন, পর্বসাম্য ভঙ্গ ও
ছন্দনিয়মের অবশেষ পরিবর্তনের পথ খুলে দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছন্দচর্চায় এক নতুন
অধ্যায় রচনা করেন। তিনি মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করেন এবং ছন্দে রূপশাসন ও ভাবপ্রকাশের
সঙ্গম ঘটান। তাঁর পদ্যগুলিতে কখনও ছন্দের নিয়মের ব্যাপক ভঙ্গ লক্ষ্য করা
যায়—অর্থাৎ ‘মুক্তক’ ছন্দ বা ছন্দহীনতাজনিত ধরণ। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম (নজরুল), স মুক্তকথা (মুক্তকবিতা) প্রভৃতি ধারার কবিরা ছন্দের গতিধারাকে আরও প্রসারিত
করেন। নজরুলের কবিতায় ছন্দ ও তাল কখনও খুব নমনীয় হয়ে উঠে, কখনও কঠোর ধাঁচে।
বিংশ শতকের শেষে ও একবিংশ
শতকের শুরুতে বাংলা কাব্যে ছন্দের প্রতি মনোভাব আরও নমনীয় ও বিচ্ছিন্ন হয় — অনেক
কবি আংশিক ছন্দ, রসালি ক্রম, মুক্তছন্দ প্রভৃতি রূপে গমন করেন।
বর্তমান বাংলা কবিতায় ছন্দ
এবং ছন্দবিচ্যুতি একত্রিতভাবে দেখা যায়। অনেক কবিতা তেমন কঠোর ছন্দে বাঁধা না থেকে
ছন্দের আভাস বা ছন্দের ছোঁয়া রাখে। ছন্দহীন (free verse) কবিতাও সাধারণ হয়েছে। কিন্তু ‘মুক্তক’ ধারা বাংলা কাব্যে
প্রবল প্রভাব ফেলেছে — যেখানে ছন্দ নিয়ন্ত্রণ কম, ভাবপ্রবাহ ও ভাষার অভিব্যক্তি প্রাধান্য পায়। আবার কেউ কেউ ছন্দকে নতুনভাবে
সংজ্ঞায়িত ও উদ্ভাবন করছেন — যেমন অপ্রত্যাশিত ছন্দ, ছন্দিত গতি বা দেহমূল ছন্দ।
সারাংশে, বাংলায় ছন্দচর্চার বিকাশ একটি ‘কাঠি ভাঙা’ ধরণের বিবর্তন —
প্রথাগত ছন্দ থেকে উদ্ভাবনী ছন্দের দিকে ধাপে ধাপে সরে আসা।
কোনো শৈল্পিক উপাদানই নিজে
নিজে বিবর্তিত হয় না — সে বিবর্তন ধাপে ধাপে বিভিন্ন বাহ্য ও অভ্যন্তরীণ কারণ
দ্বারা প্রভাবিত হয়। ছন্দের ক্ষেত্রেও
তেমনই। প্রতিনিয়ত ভাষায় ধ্বনির গতি,
স্বরের
পরিবর্তন ঘটে। নতুন উচ্চারণ রীতি, আঞ্চলিক প্রবণতা, ধ্বনিসমূহের পরিবর্তন ছন্দকে প্রভাবিত করে। শুদ্ধ উচ্চারণ
থেকে কথ্য উচ্চারণে স্থানান্তর ছন্দের সীমা পরিবর্তন ঘটায়। শব্দসংকোচন, ধ্বনিভ্রংশ, ধ্বনিসংযোজন ইত্যাদি
ভাষাগত প্রক্রিয়া ছন্দের নির্ধারক ধারা পরিবর্তন করে। যেসব যুগে ভাব-গভীরতা ও
উদ্ভাবন বেশি, ছন্দ তার নিজেকে অভিযোজিত করে
— কখনো ছন্দকে নমনীয় করে, কখনো ছন্দের গঠনকে
পরিবর্তন করে। আধুনিক কবিতা ঘিরে যে “অপ্রথাগততা ও স্বাধীনতা” আকাঙ্ক্ষিত হয়েছে, সে কারণে কিছু কবি ছন্দবিচ্যুতি গ্রহন করেছেন।
পাঠকের মনোভাব পরিবর্তন —
পাঠক আজ কঠোর ছন্দরূপে আবদ্ধ থাকতে চায় না;
কবিতার
ভাবকে যদি ছন্দে সীমাবদ্ধ করা যায় না,
তা
ছাঁটাই বা ছন্দবিচ্যুতি প্রাধান্য পায়। প্রতিটি যুগের কবি নতুনত্ব সাধনায় আগ্রহী —
তাঁরা নতুন ছন্দ, ছন্দবিদ্রোহ, ছন্দবিচ্যুতি ইত্যাদির সন্ধান করেন। ছন্দপ্রকাশ ও
ছন্দবিচ্যুতির সংবর্ধনায় সাহিত্য চর্চা ও আলোচনা — যেমন ছন্দবিমর্ষ, ছন্দনিয়োগ বিশ্লেষণ — একটি সংস্কৃতিগত পরিবেশ তৈরি করে।
ভাষা ও কাব্যতত্ত্বের নতুন
আলোচনায় ছন্দপ্রথম ধারা পুনর্বিবেচিত হয় — যেমন ধ্বনিতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব ও সাইবর্গ বিশ্লেষণ। মুদ্রণ প্রযুক্তির প্রসার, কবিতার পাণ্ডুলিপি,
সম্পাদনা
প্রক্রিয়া — এ সব প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ছন্দচর্চাকে প্রভাবিত করে। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, অনলাইন প্রকাশনা
যেখানে পাঠক তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা পড়ে,
এমন
পরিবেশে দীর্ঘ কঠোর ছন্দের আবেদন কম হতে পারে। ডিজিটাল মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া ও দ্রুত পাঠশৈলীর যুগে ছন্দকে সংক্ষিপ্ততা ও
অভিব্যক্তিমুখী হিসেবে বিবর্তিত হতে হয়। সমাজের দ্রুত পরিবর্তন, শহুরে জীবনের গতি ও অস্থিরতা ছন্দকে নমনীয় করতে বাধ্য করে।
বিশ্ব সাহিত্যের ছন্দ রীতি
(উদাহরণস্বরূপ, ইংরেজি, ফরাসি ছন্দ) বাংলা সাহিত্যে প্রভাব ফেলেছে, ফলে কিছু কবি আন্তর্জাতিক ছন্দ বিন্যাস অনুকরণ করছেন। ভাষার
বিনিময় ও সংস্কৃতিগত সংযোগ (যেমন লোকসংগীত,
গান, বৈশ্বিক কবিতা) ছন্দচর্চায় নতুন দৃষ্টিকোণ আনছে। এই কারণে
মিলিতভাবে ছন্দের ধরণ পরিবর্তন ও বিবর্তনের প্রক্রিয়া চালায়।
নিচে ছন্দ বিবর্তনের একটি
সম্ভাব্য ধাপ-রূপ রূপায়ণ দেওয়া হলো:
প্রচলিত ছন্দচর্চা
→ কবি নির্ধারিত ছন্দ নিয়ম (যেমন পয়ার) মেনে কাজ করে।
ছন্দবিচ্যুতি শুরু
→ কখনো এক বা দুই ধরণের ছেদ, অনুগামী ভঙ্গ, যতির পরিবর্তন।
আংশিক ছন্দহীন উপাদান যুক্ত
→ কিছু অংশ কঠোর ছন্দের অধীনে, অন্য অংশ
ছন্দবিচ্যুতিতে।
নতুন ছন্দ উদ্ভব
→ ছন্দবিদ্বেষী ছন্দ, অমিত্রাক্ষর ছন্দ, দেহমূল ছন্দ ইত্যাদি।
মুক্তছন্দ (Free Verse / স্বল্প ছন্দ)
→ ছন্দের বাধা অনেকখানি খোলস সংকুচিত হয়,
ভাবপ্রবাহ
ও গতি প্রাধান্য পায়।
ছন্দ ও ছন্দবিচ্যুতি সঙ্গম
→ ছন্দর পরিবর্তন মাঝে মাঝে ছন্দের “আভাস” রেখে যায়; ছন্দ ও মুক্তগতি একসাথে কাজ করে।
এই ধাপগুলি কখনো স্পষ্টভাবে
আলাদা থাকে না — একটি কবিতায় একাধিক ধাপ একসাথে কাজ করতে পারে।
অমিত্রাক্ষর ছন্দ — যার
সীমাবদ্ধতা থাকে না, যা মধুসূদন দত্ত
প্রবর্তন করেন।
মুক্ত ছন্দ / অংশমুক্ত ছন্দ —
যেখানে ছন্দাঠ রূপে সম্পূর্ণ নিয়ম থাকে না,
তবে
ছন্দের ছোঁয়া থাকে।
নবছন্দ / আধুনিক ছন্দ — যেমন
অসম ছন্দ, যত্রতত্র ছেদাবলম্বন, ছন্দের গতি পরিবর্তন,
ছন্দবহির্ভূত
বাক্য বিন্যাস ইত্যাদি।
কিছু কবি এখনও নির্দিষ্ট ছন্দ
(যেমন পয়ার, অক্ষরবৃত্ত) বজায় রেখে কাজ
করেন, কিন্তু সেই ছন্দকে পরিবর্তন ও
নমনীয়তা দিয়ে প্রয়োগ করেন।
অনেক কবি ছন্দকে মনে রেখেই
লেখেন, কিন্তু ছন্দকে বাধ্য না করে —
অর্থাৎ ছন্দ থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে — এই রকম নমনীয় শৈলী গ্রহণ করছেন।
ছন্দবিচ্যুতি, অমিত ছেদ, গতি পরিবর্তন, উচ্চারণচালিত ছন্দ —
এসব ব্যবহারে সমসাময়িক কবিতায় ছন্দের নতুন দিক দেখা যাচ্ছে।
ছন্দ এবং ছন্দহীনতার
মেলবন্ধন: কবিতার মধ্যে কোথাও ছন্দ থাকবে,
কোথাও
ছন্দবিচ্যুতি থাকবে — এই সন্নিবেশশৈলী আজ প্রায় প্রবণ।
ছন্দবিচ্যুতি অত্যধিক হলে
পাঠক বিভ্রান্ত হবে — ছন্দহীনতা বা ছন্দবিচ্যুতি অতিরিক্ত থাকলে কবিতার শিলাসত্তা
হারাতে পারে।
ছন্দ ও ভাবপ্রকাশের দ্বন্দ্ব
— কখন ছন্দ নিয়ন্ত্রণ বেশি করলে ভাবপ্রকাশের পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
উচ্চারণ বৈচিত্র্য — বাংলা
উচ্চারণের আঞ্চলিকতা ও পরিবর্তন ছন্দচলনকে ঝঞ্ঝাটপূর্ণ করে দেয়।
শিল্প-মান বজায় রাখা — নতুন
ছন্দ উদ্ভাবন করলে তার সৌন্দর্য, সান্দ্রতা ও শৈলুমান
বজায় রাখতে হবে, নতুবা ছন্দ হতে
ছিন্নভাব হয়ে যেতে পারে।
আলোচনা ও গ্রহণযোগ্যতা — নতুন
ছন্দ যতই সৃজনশীল হোক, পাঠক ও সমালোচক গ্রহণ
করবেন কি না, সেটি একটি চ্যালেঞ্জ।
ছন্দবিহীনতা কখনো ছন্দহীণতা
নয় — নতুন ও সৃজনশীল ছন্দবিচ্যুতি কবিতাকে উন্মুক্ত করতে পারে।
নতুন ছন্দ উদ্ভাবনে ছন্দের
অভ্যন্তরীণ সঙ্গতি ও বাহ্যিক ছন্দের ছোঁয়া দুইই রাখতে হবে।
ছন্দ ব্যবহার করলে
পাঠককেন্দ্রিক ভাব ও ভাষাগত সাবলীলতা বজায় রাখা যাওয়া উচিত — অর্থাৎ ছন্দকে নিজেই
বেছে নেয়া, ছন্দকে বাধ্য না হওয়া।
ছন্দ বিশ্লেষণ, ছন্দ–ব্যবহারের ইতিহাস পড়া ও অনুশীলন সত্যিই জরুরি — ছন্দের
বিবর্তন বোঝার জন্য।
কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ছন্দ
বিবর্তন একটি গভীর ও রূপান্তরমূলক প্রক্রিয়া। প্রথাগত ছন্দ থেকে শুরু করে
ছন্দবিচ্যুতি ও নতুন ছন্দের দিকে যাত্রা,
বাংলা
কাব্যে এটি ইতিমধ্যে বিস্তৃতভাবে ঘটেছে। ছন্দ শুধু নিয়ম নয় — এটি অনুভূতির গতি, ভাষার চাপ ও শ্বাসের ঘূর্ণি। ছন্দের বিবর্তন কবিতা ও
ভাষা—উভয়কেই নতুন দিক এনে দেয়, নতুন সম্ভাবনা
তৈরি করে।
কবিতায় ছন্দের পরীক্ষা ও
পরিবর্তন গতি ধীরে-ধীরে করা উচিত — বড় পরিবর্তন একবারে না, ধাপে ধাপে।
আধুনিক প্রযুক্তি (যেমন শব্দ
বিশ্লেষক, ডিজিটাল কবিতা প্রকাশ মাধ্যম)
ব্যবহার করে নতুন ছন্দ পরীক্ষা করা যেতে পারে।
তথ্যসূত্র—
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছন্দ ও গীতিকার রীতি,
বিশ্বভারতী
প্রকাশন, শান্তিনিকেতন, ১৯৪০।
২. মাইকেল মধুসূদন দত্ত, চণ্ডীদাসের পদ ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,
১৮৬১।
৩. সুকুমার সেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড), আনন্দ পাবলিশার্স,
কলকাতা, ১৯৭৮।
৪. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, চর্যাগীতি, বঙ্গীয় সাহিত্য
পরিষদ, কলকাতা, ১৯১৬।
৫. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ছন্দ ও কবিতা, মিত্র ও ঘোষ
পাবলিশার্স, ১৯৫৫।
৬. সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ছন্দ-বিচার, কলকাতা, ১৯৩০।
৭. ড. মুহম্মদ এনামুল হক, বাংলা ছন্দতত্ত্ব,
ইসলামিক
ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ১৯৮৫।
৮. অমলেন্দু বিশ্বাস, আধুনিক বাংলা ছন্দচর্চা ও তার বিবর্তন, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০০২।
৯. ড. মোহিতলাল মজুমদার, ছন্দ ও কাব্যরীতি,
বিশ্বভারতী
গ্রন্থাবলী, ১৯৬২।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment