বাতায়ন/তৈমুর
খান সংখ্যা/ছোটগল্প/৩য় বর্ষ/৩২তম
সংখ্যা/১১ই অগ্রহায়ণ,
১৪৩২
তৈমুর
খান সংখ্যা | ছোটগল্প
পারমিতা
চ্যাটার্জি
আমি
পর্ণা রায়
"অরবিন্দ বলেছিল আমি দুঃখিত পর্ণা আমি এটা চাইনি বিশ্বাস কর, পর্ণা বলেছিল ঠিক আছে আমরা তো ভালবাসি, একটু থেমে অরবিন্দ বলেছিল সামনের মাসে আমার বিয়ে, আামায় তুমি ক্ষমা কর।"
আজ গাড়িতে কত ফুলের
স্তবক মনটা আনন্দে ভরপুর হয়ে আছে পর্ণার, আজ সাহিত্যসভায় সে ভীষণভাবে সমাদৃত হয়েছে, তার জলসাঘর বইটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে,
কত বড়
কাগজের সম্পাদকরা এসেছিল তার ইন্টার্ভিউ নিতে, সবাইকে দিয়েছে, সবার সাথে সে সুন্দর
ভাবে কথা বলেছে, শুধু একজন হ্যাঁ শুধু
একজনকে সে ফিরিয়ে দিয়েছে, খুব শক্ত গলায় তাকে
বলেছে, 'আমি সবাইকে ইন্টার্ভিউ দিই না, পর্ণা লক্ষ্য করেছে তার কথা শুনে মানুষটার চোয়াল
শক্ত হয়ে গেছে, হয়তো কোন প্রতিশোধ নেবে, কাল তার কাগজে পর্ণার নামে অনেক বাজে কথা লিখবে, লিখুক তবুও আজ এতদিন পরে পর্ণার বুকটা হালকা লাগছে
অনেকদিনের জমা অপমান, জমা কান্নার কিছুটা
হলেও লাঘব হয়েছে।
ভিক্টোরিয়ার সামনে দিয়ে হুহু
করে ছুটে চলছে তার গাড়ি, বসন্তের ঠান্ডা বাতাস
জুড়িয়ে দিচ্ছে তার শরীর মন, গাড়ি ঢুকল এলগিন
রোডে, তার ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়াল, তার ফ্ল্যাট কথাটা ভাবলেই কেমন অবাক লাগে, একসময় তার মাকে নিয়ে এই শহরের এক বড়লোকের বাড়ির অন্ধকার
কাজের লোকের থাকার ছোট একচিলতে ঘরে দিন কাটিয়েছে, মা সে বাড়ির রান্না করত আর সে সকালে রাস্তার কল থেকে
জল ভরে মা-মেয়ের রান্না করে ঘর পরিষ্কার করে, দুটো ফেনা ভাত খেয়ে স্কুল ছুটত, অনেক কষ্ট করে পড়াশোনাটা চালিয়েছিল, বাংলায় সব চেয়ে বেশি নাম্বার পেত তাই তার পড়াটা স্কুল পক্ষ
থেকে ফ্রি করে দিয়েছিল।
-ম্যাডাম?
চমকে গেল পর্ণা দারোয়ানের ডাক
শুনে, সে এখন ম্যাডাম ভাবতেও অবাক
লাগে, এই জায়গাটা সে নিজেই করেছে
তার যোগ্যতা দিয়ে, কেউ তাকে কোন সাহায্য
করেনি, আবার দারোয়ানের ডাকে
সম্বিত ফিরে এল, তাড়াতাড়ি ওর সাহায্যে
ফুলের বোকে, স্তবক, মিষ্টির বাক্স নামিয়ে নিয়ে লিফ্টের দিকে এগিয়ে গেল, ওপরে গিয়ে মিষ্টির বাক্সটা দারোয়ানকে দিয়ে দিল, তার মুখটা হাসিতে ভরে গেল, পর্ণা জানে এই হাসি কত আন্তরিক, একদিন সেও অপেক্ষা
করে থাকত মা কখন কাজের বাড়ি থেকে দুটো মিষ্টি আনবে। আজ মনটা খুব ফুরফুরে কত যুদ্ধ করে এই
জায়গায় সে এসেছে, ফ্ল্যাটের দক্ষিণের
বারন্দায় বসে বসন্তের হাওয়া খাচ্ছে সে শুধু সেই জানে।
মাত্র সাত দিনের জ্বরে বাবা
চলে গেলেন, অশিক্ষিত মা তখন দিশাহারা কী করবে এই
কচিমেয়েটাকে নিয়ে, বাবার অফিস থেকে
পেয়েছিল সামান্য কিছু টাকা আর মায়ের কিছু গহনা, হাজার কষ্টেও তাতে হাত দেননি বুকে করে রেখে দিয়েছিলেন পর্ণার জন্য, পর্ণার মামা দয়া করে বড়লোকের বাড়ির ওই
আশ্রয়টুকু জোগার করে দিয়েছিলেন,
চোখের
জল মুছে মাকে বলেছিলেন কী করব বল তোর বৌদি কিছুতেই তোদের বাড়িতে
রাখতে রাজি নয়, তারপর থেকে শুরু
হয়েছিল মা-মেয়ের যুদ্ধ। উচ্চমাধ্যমিক সে পাশ করেছিল অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে, তার স্কুলের একজন শিক্ষিকা তাকে পরীক্ষার সময় খুবই সাহায্য
করেছিলেন, তারই সাহায্যে সে ভর্তি
হয়েছিল কলেজে ফ্রিতে তিনি আজও তার শুভাকাঙ্খী। কলেজে সে যখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী তখন অরবিন্দ
ছিল তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
কলেজে পড়বার সময় পর্ণা আর তার
সেই শিক্ষিকা মঞ্জুদি দুজনে মিলে একটা কোচিং চালাত মঞ্জুদির বাড়ির একতলায়, সে ছোটদের পড়াত আর মঞ্জুদি উঁচু ক্লাসে। সেইসময় সে ছোটখাট
লেখা আরম্ভ করে, কলেজ ম্যাগাজিনে ছাপাও
হত তার লেখা। কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিল অরবিন্দ, অরবিন্দ বড়লোক ডাক্তারবাবার ছেলে, দারিদ্রকে সে করুণার চোখে দেখত, তবুও কী করে যেন দুজনে কাছাকাছি এসে গেল, ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়ল একে অপরের। টিউশনের টাকা দিয়ে
সে তাদের ছোট ঘরটাকে একটু ছিমছাম করে সাজাল, সুন্দর বেডকভার জানলায় পর্দা ভাল কাপ প্লেট মোটামুটি একটু ভদ্রস্থ আর কী, এই ঘরেই অরবিন্দ আসত চা খেত কত গল্প করত, মা তার জন্য নিমকি ভেজে রাখতেন নাড়ু বানিয়ে রাখতেন, মনে মনে কিছু দুরাশা পোষণ করতেন।
একদিন জ্যৈষ্ঠ মাসে হঠাৎ অসময়ে প্রবল ঝড় উঠেছে,
এলোপাথাড়ি
বৃষ্টি পড়ছে মা তখন তাঁর রান্নার কাজে গেছেন,
অরবিন্দ
এল ভিজতে ভিজতে, পর্ণা তখন বিকেলে কাজ
থেকে ফিরে গরমের জন্য স্নান করেছে, তখনও তার ভেজাচুল
দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে অরবিন্দ এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল তার দিকে, হঠাৎ কী করে যেন সব ওলট-পালট
হয়ে গেল, দুটো শরীর দুটো মন
মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
তারপরেই অরবিন্দ বলেছিল আমি
দুঃখিত পর্ণা আমি এটা চাইনি বিশ্বাস কর,
পর্ণা
বলেছিল ঠিক আছে আমরা তো ভালবাসি, একটু থেমে অরবিন্দ
বলেছিল সামনের মাসে আমার বিয়ে, আামায় তুমি ক্ষমা কর।
এরপর পর্ণা আর পিছন দিকে চায়নি, একদিকে প্রাণপণ টিউশন করেছে, পড়াশোনাকে এগিয়ে নিয়ে
চলেছে, আপ্রাণ চেষ্টায় মুছে দিতে
চাইছে সে রাতের অপমান, ভালবাসা মুছে গিয়ে
দেখা দিয়েছে এক তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা। সম্মানের সাথে বিএ পাশ, এমএ পাশ, এমফিল, পিএইচডি তারপর বেথুন কলেজের লেকচারার, তারমধ্যেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্পাদকদের দরজায় গিয়ে লেখা
দেওয়া, প্রকাশকের দরজায় গিয়ে বই
প্রকাশ। হঠাৎ তার আকাশে তারা জ্বলে উঠল পরপর তিনটি বই পুরষ্কার প্রাপ্ত হল, পরপর পাঁচটি উপন্যাস সিনেমার জন্য মনোনীত হল, এখন তো সে একজন নামকরা লেখিকা।
দেওয়ালে টাঙানো থাকত চারটি
ছবি তার বাবা-মায়ের, আর তার সেই শিক্ষিকা
মঞ্জুদি আর তার পরম ইস্ট দেবী মা কালীর। পরদিন ঘুম ভাঙল একটু বেলা করেই, কাজের মেয়ে বেলা এসে খবর দিল কেউ তার জন্য বাইরে অপেক্ষা
করছে, তাকে বসতে বলে নিজে তাড়াতাড়ি
বাথরুমে গিয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে এল, যে এসেছে তাকে দেখে খুব সহজভাবে বলল, ওঃ আপনি! আমি তো বলেছি আপনার কাগজের জন্য আমি কোন
ইন্টার্ভিউ দেব না...
-আমি তোমার কাছে ইন্টার্ভিউ নিতে আসিনি...
-তবে কেন এসেছেন?
একটা রাঁধুনির মেয়ে
এখনও সেই ছোট খুপরিতে থাকে কিনা দেখার জন্য, কেন এসেছেন এখনও তার সাথে ভালবাসার অভিনয় করা যায় কি না দেখার জন্য? এখন আমার পরিচয় লেখিকা পর্ণা রায়, বেথুন কলেজের শিক্ষিকা, আমি কবে কোনদিন রাঁধুনির মেয়ে ছিলাম সে পরিচয় মুছে গেছে, মুছে গেছে কোনদিন আমি একচিলতে ঘরে একটা আশ্রয়ের মধ্যে
থাকতাম, আমার মা এখন আর কোন রাঁধুনি নন, কিন্তু তিনি কারও দয়ায় নয় নিজের পরিশ্রমে আমায় বড় করেছেন, তিনি এখন লেখিকা পর্ণা রায়ের মা, আমার এ পরিচয় আমি গড়ে তুলেছি আমার যোগ্যতা দিয়ে, সমাজের মানুষ আমায় স্বীকৃতি দিয়েছে, হ্যাঁ লেখিকা পর্ণা রায়কে, আজ কেন এসেছেন আমার কাছে?
-এসেছি একটা কথাই বলতে,
একটা
গল্প লিখবেন প্লিজ… যেখানে আমাদের মতন লুকিয়ে
থাকা কিছু মেরুদণ্ডহীন পুরুষ বাস করে তাদের জন্য, তাদের চরিত্রটা সবার কাছে তুলে ধরুন না?
পর্ণা নিজের উত্তেজনাকে সংযত
করে দরজা দেখিয়ে বলল বেরিয়ে যান প্লিজ বেড়িয়ে যান।
বেরিয়ে গেল
বিখ্যাত কাগজের নামকরা সাংবাদিক অরবিন্দ দত্ত।
সমাপ্ত

No comments:
Post a Comment