প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা ~ ~ ~ নাম নয় মানই বিবেচ্য

তৈমুর খান সংখ্যা | মগজ ও অঙ্গ

বাতায়ন/ তৈমুর খান সংখ্যা/ সম্পাদকীয় /৩য় বর্ষ/ ৩২তম সংখ্যা/১১ই অগ্রহায়ণ , ১৪৩২ তৈমুর খান সংখ্যা | সম্পাদকীয়   মগজ ও অঙ্গ "অপরিসীম মেধ...

Tuesday, November 25, 2025

কুনজুম পাস ও চন্দ্রতাল | ডঃ শেষাদ্রি শেখর ভট্টাচার্য

বাতায়ন/তৈমুর খান সংখ্যা/ভ্রমণ/৩য় বর্ষ/৩তম সংখ্যা/১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
তৈমুর খান সংখ্যা | ভ্রমণ
ডঃ শেষাদ্রি শেখর ভট্টাচার্য
 
কুনজুম পাস ও চন্দ্রতাল

"একটু আগেই আমরা এই পথের সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল অংশ পেরিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছি, যেখানে গলে যাওয়া গ্লেসিয়ার থেকে জলধারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে ছোট-বড় বোল্ডারে ভরা রাস্তায়। আমাদের ট্রাভেলারের একটা চাকা এক বোল্ডারে আটকে গিয়েছিল।"

 
ভোর ৫টায় কাজা-র তাপমাত্রা ৩° সেন্টিগ্রেড। ভোর ৪টেয় উঠে সকলে এক এক করে তৈরি হয়ে নিয়েছি। আমরা লাগেজ নিয়ে নীচে নেমে এলাম। সেগুলো গাড়িতে ওঠানো হতেই আমরা চড়ে বসলাম সিটে। ট্রাভেলার চলতে শুরু করল ভোর সোয়া ৫টায়। আমরা চলেছি এক নতুন পথ ধরে। দেখছি, সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়েছে পর্বতচূড়ায়।

রাস্তা প্রথম থেকেই খারাপ। কী-তে পৌঁছলাম মিনিট ২০ পরে। পথের ডান-পাশে এক বৃদ্ধাশ্রম দেখে একটু অবাক হলাম। প্রায় সমগ্র স্পিতি ভ্যালিতে পাহাড়ের বিভিন্ন রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছি বারবার। ততটাই মুগ্ধ হয়েছি নদী ও উপনদীর রূপে। এখন চলেছি এই ট্রিপের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তা ধরে কখনও ধ্বসপ্রবণ এলাকা পেরিয়ে, কখনও অতল গিরিখাতের পাশ দিয়ে। চিচাম ব্রিজের কাছে এসে পৌঁছলাম সকাল ঠিক ৬টায়।
কুনজুম পাস

পথের বাঁ-দিকে তাকালে চোখে পড়ছে পরপর ৩টে তুষারাবৃত শৃঙ্গ। গ্রাম-সড়ক যোজনায় রাস্তা তৈরি হচ্ছে চিচাম গ্রামে। এবার পথের বাঁ-পাশে পাহাড়ের ঢালে হলুদ রঙের ঘাসফুল। মাইল স্টোনে তাকিয়ে দেখি, লোসার আরও ৩১ কিমি দূরে, আর কিয়াটো ১৩ কিমি দূরে। বাঁ-দিকের পাহাড় থেকে এক জলপ্রপাত ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীচে। প্রাকৃতিক কারণে তৈরি বিভিন্ন আকৃতির পাহাড়-চূড়া দেখে আশ্চর্য হচ্ছি বারবার। কিব্বের ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঞ্চুয়ারির শেষ প্রান্তে চলে এলাম। এবার ডান-দিকের পাহাড় থেকে নেমে এসেছে জলপ্রপাত। কিয়াটো-তে এসে থামল আমাদের গাড়ি আমরা সেখানে চা পান করব। ঘড়িতে তখন সকাল ৬টা ৫০ মিনিট। চা খেতে খেতে দেখছি জায়গাটার অসাধারণ সৌন্দর্য। তাড়াতাড়ি গাড়িতে এসে উঠলাম। কিছুক্ষণ পরে হানসা নামের এক ছোট্ট গ্রাম পেরোলাম। স্পিতি নদী তখন প্রায় আমাদের সমতলে বয়ে চলছে।
কুনজুম পাস

আমাদের পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পাল ইয়াক ও পাহাড়ি গোরু। তাদের সরিয়ে রাস্তা বের করতে কয়েক মিনিট সময় লাগল। এক বিরাট ঝোড়া পাহাড় থেকে নেমে স্পিতি নদীতে গিয়ে মিশেছে লোসারে এসে পৌঁছলাম ৭টা ৫০-এ। স্পিতি নদীতে খুব স্রোত এখানে। আমরা একটা ধাবায় ঢুকলাম প্রাতরাশ করার জন্য। আমাদের মধ্যে কেউ আলু-পরোটা, কেউ আবার ডিম-নুডলস অর্ডার করল। স্পিতি নদীর ডান তীরে অবস্থিত লোসার খাস বা লোসার গ্রাম, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ৪০৯০ মিটার (১৩,৪২০ ফুট)। লোসার গ্রাম পঞ্চায়েত একটি স্থানীয় সরকারি সংস্থা লোসার খাস এবং আরও ১২টি নিকটবর্তী গ্রামের জন্য। এনএইচ-৫০৫-এ অবস্থিত লোসার-এর অবস্থান স্পিতি অঞ্চলের কাজা ও লাহুল অঞ্চলের গ্রামফুর মাঝে অবস্থিত।
কুনজুম পাস

ব্রেকফাস্ট সেরেই আমরা ট্রাভেলারে চড়ে বসলাম। গাড়ি এগিয়ে চলল। কিছুক্ষণ পরেই আমরা চন্দ্রতাল সংরক্ষিত অঞ্চলে প্রবেশ করলাম। সরু রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। বিপদসঙ্কুল পথের পাশেই গভীর খাদ। এবার রাস্তার বাঁ-পাশে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে শক্তিশালী জলপ্রপাত। ক্রমশ আমরা কুনজুম পাস-এর কাছে চলে এলাম। ‘কুনজুম পাস’ বা ‘কুনজুম লা’ হলো হিমাচল প্রদেশে অবস্থিত হিমালয় পর্বতমালার পূর্ব কুনজুম রেঞ্জের একটি উচ্চ পার্বত্য পথ। ৪৫৫১ মিটার (১৪,৯৩১ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত কুনজুম পাস হলো লাহুল ও স্পিতি ভ্যালির মাঝে গেটওয়ে বা প্রবেশপথ।
চন্দ্রতাল

গাড়ি থেকে নামতেই আমরা চারপাশের দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই বরফ-ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ। কোথাও নেমে এসেছে গ্লেসিয়ার (বড়া-শিগরি) আবার কোথাও দেখা যাচ্ছে সুন্দর উপত্যকা। প্রথমে পৌঁছলাম কুনজুম দেবী (মা দুর্গা) মন্দিরে সেখানে মাকে প্রণাম জানিয়ে গেলাম পাশেই অবস্থিত বুদ্ধ মন্দিরে। এবার চলে এলাম সেই অপরূপ উপত্যকার কাছে। বেশ কাছ থেকেই দেখতে পাচ্ছি তুষার-মণ্ডিত চন্দ্রভাগা রেঞ্জ। মনে হচ্ছে, স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তবে তা এখানেই।

প্রায় ২০-২৫ মিনিট সেখানে কাটিয়ে আমরা এগোতে লাগলাম চন্দ্রতালের পথে। পথ বেশ বিপজ্জনক। এবার সেই স্পিতি নদীর জন্মস্থান দেখতে পেলাম। হিমালয়ের কুনজুম রেঞ্জ থেকে উৎপন্ন হয়ে এই নদী লাহুল ও স্পিতি অঞ্চলকে বিভক্ত করেছে। পিন নদী-সহ হিমালয়ের অনেক জলধারা স্পিতির বুকে এসে মিশেছে। দেখলাম, একপাল ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে হিমালয়ের পাদদেশে। আরও দেখছি, স্পিতি নদীর তীরে বেশ কয়েকটি ঘোড়া ঘোরাফেরা করছে। মনে হচ্ছে, এই সব যেন কোন এক রূপকথার দৃশ্য।
চন্দ্রতাল

একটু আগেই আমরা এই পথের সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল অংশ পেরিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছি, যেখানে গলে যাওয়া গ্লেসিয়ার থেকে জলধারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে ছোট-বড় বোল্ডারে ভরা রাস্তায়। আমাদের ট্রাভেলারের একটা চাকা এক বোল্ডারে আটকে গিয়েছিল। তখনই সেখানে উপস্থিত কয়েকজন বাইকারের সহায়তায় আমাদের ড্রাইভার গাড়ি সামান্য পিছনে নিয়ে এসে বোল্ডারকে পাশ কাটিয়ে পার হয়ে গেল ওই জায়গা। এবার আমরা পৌঁছে গেলাম চন্দ্রতালের ক্যাম্পসাইট-এ। সামনে বিভিন্ন গাড়ির লম্বা জ্যাম। মিনিট দশ পরে আমাদের ট্রাভেলার পার্ক করা গেল। প্রথমেই আমি গাড়ি থেকে নেমে এক অস্থায়ি টিকিট কাউন্টারে সাত জনের জন্য প্রবেশ মূল্য জমা দিলাম। তারপর বাকি সদস্যরা নামতেই শের সিং গাড়ির জানলা বন্ধ করে, দরজাও লক করে দিল, কারণ আমাদের লাগেজ গাড়িতেই রাখা আছে।

চন্দ্রতালের অভিমুখে হাঁটা শুরু করলাম হালকা চড়াই উরাইয়ে দেড় কিমি পথ। গন্তব্য বেশি দূরে নয়, ঋজু ও ঋভুকে নিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম আর বাকি চারজন পিছনে আসতে লাগল। ঘড়িতে তখন বেলা ১১টা ৫০ মিনিট। এক স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেবার পথে আমরা এগিয়ে চলেছি। ঢালু পথ, দু পাশেই উঁচু, উঁচু পর্বত তার নীচে চোখ-জুড়োনো সবুজ উপত্যকা। উচ্চতাজনিত কারণে সবারই একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। দুপুর সোয়া ১২টায় কিছুটা দূরে দেখতে পেলাম ঈপ্সিত হ্রদের নীলরঙের জলরাশি। এবার বাকি পথটুকু দ্রুত হেঁটে, ছোট-বড় বোল্ডারের উপর পা রেখে, হ্রদ থেকে উৎপন্ন জলধারা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম অপরূপ সুন্দর, নীলবর্ণা চন্দ্রতাল-এর তীরে। শুভ মুহূর্তটি ছিল দুপুর ১২টা বেজে ১৮ মিনিট।
চন্দ্রতালে আমরা

চন্দ্রতাল’ লাহুল ও স্পিতি জেলার উচ্চতর চন্দ্র-উপত্যকায় অবস্থিত, যা চন্দ্রা নদীর উৎপত্তিস্থলের কাছেই। রুক্ষ ও প্রতিকূল পরিবেশে অবস্থিত হলেও এটা একটি সংরক্ষিত অঞ্চল যেখানে গ্রীষ্মকালে কয়েক প্রকার ফুল ও বন্যপ্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩,৯৪০ ফুট (৪,২৫০ মিটার) উচ্চতায় অবস্থিত চন্দ্রতাল দৈর্ঘ্যে ১.৭৬ কিমি এবং প্রস্থে ০.৪১ কিমি। হ্রদের গভীরতা গড়ে ২৩.৯ ফুট হলেও গভীরতম অংশ ১৩৯.৪ ফুট নীচে। সাধারণত স্পিতি অঞ্চলের সঙ্গে উল্লখিত হলেও, ভৌগোলিকভাবে চন্দ্রতালের অবস্থান লাহুল অঞ্চলে।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখতে লাগলাম চন্দ্রতাল-কে। সম্বিত হতেই কর্কশ জমির ওপর জুতোজোড়া খুলে রেখে হ্রদের জলে পায়ের পাতা ভেজালাম, মাথায় ছোঁয়ালাম চন্দ্রতালের পূণ্যবারি। ততক্ষণে আমাদের দলের বাকি সদস্যরা একে একে চলে এসেছে হ্রদের তীরে। পরের ২৫-৩০ মিনিট ধরে আমরা হ্রদের ধারে হেঁটে বেড়ালাম, যথেচ্ছ ছবি তুললাম চন্দ্রতালের এবং সেই অপূর্ব প্রেক্ষাপটে নিজেদের ছবিও। সবারই মন আনন্দে পরিপূর্ণ। চন্দ্রতালের কাছে প্রায় এক ঘণ্টা সময় কাটিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। দুর্গম পথে গাড়ি ফিরে চলল বাতাল-এর পথে।
 
 

No comments:

Post a Comment

'ও মন তরে কে-বা পার করে...'


Popular Top 10 (Last 7 days)