বাতায়ন/ধারাবাহিক/১ম বর্ষ/১২তম সংখ্যা/১৫ই আষাঢ়,
১৪৩০
ধারাবাহিক
ডঃ হর্ষময় মণ্ডল
[২য় পর্ব]
মুছে
যাওয়া দিনগুলি
পূর্বানুবৃত্তি:
প্রতিষ্ঠিত
হোমিয়োপ্যাথির ডাক্তার সুকোমল হঠাৎ একদিন ছাত্রজীবনের পরিচিত শেফালীদির চিঠি
পেয়ে অবাক হয়ে গেল। অথচ ঘনিষ্ঠতায় তাদের বাড়ির ছেলে হয়ে ওঠা, শেফালীদির মা মারা
যাওয়ার পরে তাদের লোকাল গার্জেন হয়ে ওঠা সত্ত্বেও জ্যেঠতুতো দাদা অঞ্জনদা ওদের
বাড়িতে আসে। একদিন শেফালীদি বা তার ভাইয়েরা কেউ বাড়িতে ছিল না। সুকোমল ওদের বাড়িতে
গিয়ে রন্টি নামের একটা মেয়ের সঙ্গে আপত্তিজনক অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখে অঞ্জনদাকে।
সেই নিয়ে শেফালীদিকে বলাতে শেফালীদি সুকোমলকে অপমান করে। তারপর…
পরের দিন শেফালীকে বলল, শেফালী কোন গা তো করলই না
উল্টে বলল দেখো সুকোমল তোমাকে যেমন স্নেহ করি তেমনি অঞ্জনদাকে সম্মান করি।
অঞ্জনদার সম্বন্ধে কোন বিরূপ মন্তব্য শুনতে চাই না। তুমি অঞ্জনদার সম্বন্ধে বলছ
নিজের সম্বন্ধে বলছ না কেন? না লোকের দোষ দেখিয়ে নিজেরটা গোপন করতে চাইছ? “মানে?”
সুকোমল আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল। “মানে? মানেটা তুমি জানো না? না ভাবছ
শেফালীদি কিছু জানে না? তোমার সাথে টুম্পার যে দৈহিক সম্পর্ক আছে সেটা আমি ভাল ভাবে
জানি। আমি কোন তর্কবিতর্কে যেতে চাই না। তোমার জীবন তুমি যেমন ভাবে খুশি অতিবাহিত
করতে পার তাতে আমি বলার কে! যেমন আমরা কেউ তোমার ব্যক্তিগত জীবনে ইন্টারফেয়ার করি
না তেমনই তুমিও না করলে খুশি হব। আর একটা কথা তুমি আর আমাদের বাড়ির চৌহদ্দি
মাড়াবে না তোমাকে একটু বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলাম বলে তুমি কী ভাবছ তুমি
আমাদের গার্জেন হয়ে গেছ? এখন বুঝতে পারছি তোমাকে বেশি প্রশ্রয় দেওয়াই অন্যায়
হয়ে গেছে।”
সুকোমল নিজের সাপোর্টে একটা কথাও বলেনি বুঝে গেছিল
অঞ্জন নিজের দোষ ঢাকতে শেফালীদের ব্রেন ওয়াশ করেছে সেই দিন থেকে সুকোমল আর
শেফালীদের বাড়ি যায়নি। সুকোমলের তখনও ডাক্তারি পাশ করা হয়নি ওখানে থাকতে থাকতেই
খবর পেল শেফালীর বিয়ে হয়েছে। একজন হোমিওপ্যাথি রিপ্রেজেন্টেটিভের সাথে। শেফালী ও
শেফালীর ভাইরা সবাই বসিরহাট চলে গেছে। সুকোমল বুঝতে পারল অঞ্জনকে গার্জেন বা ভগবান
সমান জ্ঞান করার কারণ। তারপর থেকে আর কোন খবর ছিল না। সুকোমল ডাক্তারি পাশ করে
নিজের দেশে ফিরে এসে ডাক্তারি শুরু করল। পাশাপাশি আবার কলেজে ভর্তি হল। সরকারি
অফিসে চাকরি পেল। বিয়ে করল। একটি ছেলে হল। সে-ও এখন মাধ্যমিক দেবে, মাঝে প্রায়
কুড়ি-বাইশ বছর কোন যোগাযোগ নেই এর মধ্যে সুকোমল লেখক হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছে।
নিজের ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিচারণা থেকে বেরিয়ে এসে আবার মন দিল চিঠিতে—
ভাগাড়ে শবদেহ পড়লে শকুনরা যেমন হামলে পড়ে সেই রকম বাবা মারা
যাওয়ার পর অঞ্জনদা হামলে পড়েছিল আমাদের উপর। বুঝতে পেরেছিল আমাদের হাতে অনেক
টাকা আছে। সেই টাকা আত্মসাৎ করার জন্য ভাল মানুষ সেজে আমার বিয়ে দিল একজন
হোমিওপ্যাথি রিপ্রেজেন্টেটিভের সাথে এবং ভাইদের বিজনেস খুলে দেবে এই বলে প্রতিশ্রুতি
দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলে এল বসিরহাটে। ভাইদের জন্য বিজনেস খুলল যা বছর কয়েকের মধ্যে
ভরাডুবি হয়ে বন্ধ হয়ে গেল।
আর আমার স্বামীর ওষুধ কোম্পানিও বন্ধ হয়ে গেল। আজ থেকে বছর দশেক
আগে। আমার স্বামী এখানে তেমন কোন রোজকারের সুরাহা করতে না পেরে আমাকে ছেড়ে
বাংলাদেশে চলে গেল সেখানে একটি মেয়েকে বিয়ে করে ওখানেই থাকে। আমি এখন
শ্বশুরবাড়ির গলগ্রহ কেউ আমাকে সহ্য করতে পারে না। ভাইরা যে যার নিজেদের মতো করে
সংসার পেতেছে। তাদেরও কষ্টেসৃষ্টে কোনরকম সংসার চলছে। তাদের সংসারে গিয়ে থাকব সে
অবস্থাও নেই। যাই হোক অনেক কষ্টে তোমার লেখা বই থেকে তোমার ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি
দিলাম সব খুলে লিখলাম।
আমার কথা বিশ্বাস করো মুখ ফিরিয়ে নিও না ভাই। তুমি আমাকে তোমার কাছে
নিয়ে চল। আমি কিছু চাই না কেবল শরীর ঢাকতে মোটা শাড়ি আর তিন বেলা পেট ভর্তি
খাবার। আমি বাঁচতে চাই, সুকোমল তুমি আমাকে বাঁচাও।
ইতি—
তোমার শেফালীদি
কতক্ষণ যে চিঠি নিয়ে সুকোমল বসে আছে খেয়াল নেই
সম্বিত ফিরল স্ত্রীর ডাকে “কী হল চুপচাপ বসে আছ? ক'টা বাজে খেয়াল আছে? কখন স্নান
খাওয়া করবে?” কথা বলতে ভাল করে সুকোমলকে দেখে বলল, “কী হয়েছে বল-তো? এমন
দেখাচ্ছে কেন? তোমার কি শরীর খারাপ?” সুকোমল স্ত্রীকে চিঠিটা বাড়িয়ে দিল। সুকোমলের
স্ত্রী বিপাশা চিঠিটা আদ্যোপান্ত পড়ে সুকোমলের দিকে সোজাসুজি তাকাল। সুকোমল বলল, “কী
করি বল-তো?” বিপাশা বলল, “কী করি মানে! নিয়ে এসো।” সুকোমল অবাক হয়ে বলল, “কী বলছ
তুমি? ভেবেচিন্তে বলছ?” “হ্যাঁ ভেবেচিন্তে বলছি। তোমরা দিস্তার পর দিস্তা কাগজে
গল্প, কবিতায় নারী অত্যাচারের বিরুদ্ধে লিখছ অথচ বাস্তবে কিছুই করছ না। একটা
বাস্তব কাজ করে দেখাও যে অন্তত একটা নারীকে বাঁচার অবলম্বন দিতে পেরেছ। শোনো চিঠি
পড়ে মনে হচ্ছে সত্যিই খুব দুর্দশায় আছেন ভদ্রমহিলা। তুমি পারলে কালই রওনা হয়ে
যাও।”
সুকোমলের মনে হল সে একটা বটবৃক্ষের ছায়ায়
দাঁড়িয়ে আছে। খুব ভাল লাগল নিজের স্ত্রীকে। এর আগে এত ভাল লেগেছে বলে মনে পড়ল
না।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment