প্রাপ্তমনস্কদের পত্রিকা

মননশীল কলমকে উৎসাহ দিতে... পড়ুন, পড়ান, আপনার মূল্যবান মতামত দিন।

ওয়েটিং লিস্টে আছি... | রতনলাল আচার্য্য

বাতায়ন/মাসিক/কবিতা/২য় বর্ষ/১৮তম সংখ্যা/২৩শে কার্ত্তিক , ১৪৩১ চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা | কবিতা রতনলাল আচার্য্য ওয়েটিং লিস্টে আছি ....

Saturday, July 22, 2023

ভোলাকেবিনে উত্তমকুমার | সিদ্ধার্থ সেন


ভোলাকেবিনে উত্তমকুমার

বাতায়ন/অন্য চোখে/১ম বর্ষ/১৩তম সংখ্যা/৫ই শ্রাবণ, ১৪৩০

 

অন্য চোখে

সিদ্ধার্থ সেন


সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে ভোলাদার কেবিনে বসে খবরের কাগজের পাতা উল্টিয়ে টোস্ট আর এক কাপ চায়ে গলা না ভেজাতে পারলে অনেকের মতো আমারও দিনটা ভাল ভাবে শুরু হয় না। গত চল্লিশ বচ্ছর ধরে এটা আমার একটা রুটিনে দাঁড়িয়ে গেছে।


সিদ্ধার্থ সেন


বাঁদিকের বেঞ্চটায় দু’টো ফাঁকা জায়গা তখনও পড়ে আছে দেখে, পা’টা ওপর দিয়ে পার করে ছোটবেলার সেই স্কুলের বেঞ্চে বসার অভ্যেসটাকে চাঙ্গা করে ধপাস করে বসে পড়ি।
কেষ্টদা’র কাছ থেকে সেদিনের কাগজের মাঝের পাতাটা নিয়ে পড়তে বসার ফাঁকেই নন্টে টোস্টটা বাড়িয়ে দেয়। টোস্টে একটা  কামড় বসিয়ে  সে দিনের হেডলাইনগুলোর ওপরে চোখটা ভাসিয়ে বেড়াই।
পাশ থেকে কাগজে কিছু একটা দেখে হেঁদো মানে হৃদয়হরণ, হঠাৎ বলে ওঠে, “আরে! আজই তো গুরুর জন্মদিন, থার্ড সেপ্টেম্বর?”
প্রশ্ন করি, “কে তোর গুরু?”
— গুরুকে চিনিস না? দা গ্রেট, গ্রেটার, গ্রেটেস্ট গুরু।
চায়ের কাপটা মুখ থেকে সরিয়ে ঘোঁতা, মানে অরূপ, জানতে চায়, “গুরুরা তো শিষ্যদের কাছে গ্রেটই হয়। তো, কী হল?”
হাঁদু ফের বলে, “আরেব্‌ বাবা, ঈশ্বর অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। বুঝেছ?”
জানলার ধারে বসা কৃষ্ণকিশোর অর্থাৎ কেষ্টদা বলে ওঠে, “চিনব না কেন। ওই তো নন্দকিশোর হাইস্কুলের চিনে মাষ্টার। চিনেদের মতো দেখতে ছিল।”
-- আরে, ধুর, সে নয়।
হাঁদার জবাব ভেসে আসে।
-- তবে কে?
বটা কাপে চুমুকটা শেষ করে বলে ওঠে।
— আরে বাবা, সব জেনারেশনের গুরু। গুরুর গুরু, উত্তমকুমার।
চায়ে ভেজানো টোস্টে একটা কামড় মেরে ভুরু দু’টো বিস্ফারিত করে হাঁদাকে উদ্দেশ্য করে বটা বলে ওঠে, “মানে?”
— আমার ঠাকুমা, মা-বাবা-ভাই-বোন মায় দাদার ছেলেমেয়ে পর্যন্ত, আমাদের সবার গুরু, উত্তমকুমার। কী ফাটাফাটি অভিনয়, কী হাসিটা, বলো?
হাঁদার সরল স্বীকারোক্তি।
এ সময়ে কাগজের সামনের পাতাটা উল্টে পরের পাতায় চোখ বোলাতে শুরু করি।
-- দ্যাখ হেঁদো, হাঁদার মতো কথা বলিসনি। উত্তমকুমার তোর গুরু বলে কী সবার গুরু বনে যাবে? তাছাড়া উত্তমের বেশ কিছু ম্যানারিজম আমার ভাল লাগে না।
কথাটা বলে ভোম্বল বিস্কুটটা চায়ের কাপে ডুবিয়ে মুখে পুরে দেয়।
-- ভোম্বল খারাপ কিছু বলেনি। তবে এটাও মানতে হবে যে, উত্তমের মতো রোমান্টিক, ম্যাটিনি আইডল, বাংলাতে আর একটাও জন্মায়নি। এটা অতি বড় সমালোচকও স্বীকার করতে বাধ্য হবে।
কথাটা বলে পল্টু আলোচনাটাকে খানিক উস্কে দেয়।
-- দ্যাখ হাঁদা, লোকে এসব কথা বললেও আমি বলি কী, সুচিত্রা সেন যদি উত্তমের পাশে না থাকত তাহলে এতটা হইহই ব্যাপার হোতো না। যদিও চিরদিন ওদের জুটিটা আনপ্যারালাল থাকবে।
ফ্রেঞ্চ টোস্টে একটা তৃপ্তির কামড় বসিয়ে প্যালা, মানে প্যালারাম চাটুজ্জে, খাওয়াতে মন দেয়।
-- আমি মানতে পারলুম না, সরি।
এই বলে ভুবন আরও বলে,
— স্ত্রী ছবিটা দেখেছ? ওটাতে তো সুচিত্রা ছিল না। ওই রকম অভিনয় উত্তম ছাড়া আর কেউ পারত? অমন ভুবন ভোলানো হাসি কি আর কেঊ হাসতে পারবে? অমন গানে লিপ দেওয়া? আহা হা হা, ফ্যান্টাস্টিক।
-- রাইট। তবে রোমান্টিক হিরোতে উত্তম যতটা সফল ক্যারেকটার রোলে ঠিক ততটা নয় বলেই আমি মনে করি। কথাটা বলে বটেশ্বর পাল। মানে আমাদের বটা। আজ মনে হয় স্কুলের ছুটি। তাই এতক্ষণ ধরে ওকে চায়ের আসরে পাওয়া যাচ্ছে।
-- একটা কথা কী জানিস হাঁদা,
এটুকু বলে টোস্টে কামড় মেরে অনেকক্ষণ পরে কেষ্ট বলে ওঠে,
— ভাল অভিনেতা হতে গেলে সব রকমের রোলে অভিনয় করে সাকসেস পেতে হয়, বুঝলি?
কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে হাঁদা বলে ওঠে,
— সে তো ঠিকই। এ আর নতুন কথা কী বললে!
-- নতুন নয়, তবে যে ব্যাপারটা বলতে চাইছি, সেটা হল, উত্তমকুমারকে সব চরিত্রে ঠিকঠাক মানাতও না। এটা তো মানবি?
চোখ থেকে চশমাটা খুলে সেটা ধুতির খুঁটে মুছতে মুছতে কথাটা পল্টু বলে।
-- মানে! কী বলতে চাইছ তুমি পল্টুদা?
উত্তেজিত হাঁদা প্রশ্নটা সোজাসুজি করে বসে তার থেকে অনেক বড়, পাড়ার পুজো কমিটির ট্রেজারার পল্লব ঘোষ মানে পল্টুকে।
পুরু গোঁফের ফাঁক দিয়ে এক ঝলক হেসে পল্টু বলে,
— রোমান্টিক চরিত্রের বাইরে গোটা কতক ছবিতে উত্তম যদিও ভাল, যেমন সাহেব বিবি গোলাম, ধন্যি মেয়ে, মৌচাক, আরও ক’টা আছে, তবুও এটা তো সত্যি যে, বাংলার সফল পরিচালকদের ছবিতে উত্তমকে সেভাবে পাওয়া যায়নি।
পল্টুকে বাধা দিয়ে ভোম্বল বলে ওঠে,
— কেন, মানিকদা নেয়নি? নায়ক সিনেমায় গুরু ছাড়া ওই রোলটা কেউ করতে পারত?
— সেই জন্যেই তো গুরুকে গুরুই চিনেছিল।
হাঁদা কথাটা বলে একটু যেন হাল্কা হল।
— হ্যাঁ। আর চিনেছিল বলেই না দু’টো ছবিতে ছাড়া আর কোনও ছবিতে নেয়নি।
কথাটা বলে বটু আরও এক রাউন্ড চায়ের অর্ডার দেয়।
হঠাৎ করে আসরে উদয় হলেন পাড়ার সিনেমা কীট গনাদা। মানে গনেন্দ্র নাথ সেন অফ সেভেন্টি ফাইভ। আসরে এসেই প্রশ্ন করেন,
— আলোচনাটা কীসের ওপর হচ্ছে?
-- উত্তমকুমার।
এই বলে গনাদার সামনে ঠাকাস করে এক কাপ চা দিয়ে নান্টু গ্লাস ধুতে লেগে যায়।
-- উত্তমকুমার, এ তো উত্তম কথা।
এই বলে চায়ে চুমুক দিয়ে গনাদা ফের বলে,
— বাংলা সিনেমায় উত্তম ছাড়া আর কাউকে রাজার আসনে বসানো যায়?
-- তুমি না আসরে ঢুকে আড্ডাটা মাটি করে দিলে গনাদা।
পাশ থেকে কথাটা বলে প্যালা টোস্টের শেষ টুকু মুখে পুরে দেয়।
-- কেন, আমি কী ভুল কিছু বললুম!
সবার মাঝে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে গনাদা মেজাজ করে ক’টা চুমুক দেয় চায়ের কাপে।
-- ভুল নয়। এক বালতি দুধে এক ফোঁটা চোনা ফেলে দিলে, গনাদা।
বাড়ির জন্যে পাঁউরুটি কিনতে এসে এক সময় এই মজলিশে ভিড়ে যাওয়া চুনীলাল মান্না কথাটা গনাদাকে উদ্দেশ্য করে বলে ফেলে।
-- দ্যাখ, তোরা অনেক ছোট। বড়দের মাঝে ঢুকে ভেবেছিল হনু হয়ে গেছিস, তাই না? তোরা আবার সিনেমা দেখলি কবে? আজকাল এগুলো কি সিনেমা? খালি লম্ফঝম্ফই সার। গানটুকু বাদ দিলে গপ্পোর কোনও ছিরিছাঁদ আছে? সবগুলোই এক ছাঁচে গড়ে বাজারে ছেড়ে দেয়। পরিবেশনের পাত্তরটাই যা আলাদা থাকে।
এতখানি বলে গনাদা চায়ের কাপে বেশ ক’টা তৃপ্তির চুমুক দেয়।
-- গনেনদা, তুমি ঠিক বলেছ। উত্তমের সঙ্গে আর কারুর তুলনা চলে না। কমার্শিয়ালি হিট একজন শিল্পী। ম্যাটিনি আইডল বলতে উত্তমের নাম ছাড়া আর কোনও নাম মনে আসে কি? কম্পোজিট অ্যাক্টর, একবার ভাব।
অনেকক্ষণ পরে পল্টু কথাটা বলে আলোচনায় ভেসে থাকতে চায়।
-- সে সময় ওরকম চেহারা আর গ্ল্যামার নিয়ে আর কেউ এসেছে? তাই তোমরা উত্তমকুমারকে নিয়ে এত আলোচনা করতে পারছ।
অনেকক্ষণ চুপচাপ আলোচনা শুনতে গিয়ে হঠাৎ করে ঘোঁতা মুখ খোলে।
— শোন ঘোঁতা, আগেকার দিনে সিনেমাতে একটা নিটোল গপ্পো বলা হত। একটা পারিবারিক গপ্পো পাশাপাশি চলত। সে সব সাহিত্যধর্মী ছবি ছিল। দেখতে ভাল লাগত। তাছাড়া অভিনেতাদের অভিনয়ও ছিল অসাধারণ। আর এখন?
এই বলে গনাদা চুপ করে যায়।
— অনেকক্ষণ ধরে এইসব আলোচনা শুনছি। সেকেন্ড রাউন্ড চা-ও শেষ হয়ে এল। এবার অফিসকাছারি যেতে হবে তো না কি?
অনেকক্ষণ ধরে এই সব আলোচনার উত্তাপ পুইয়ে, সেকেন্ড রাউন্ড চা পানও শেষের মুখে এসে যাওয়ায় ভাবলুম এবার তো সকলকে আফিস কিংবা বাজার যেতে হবে। তাই যাবার আগে বললুম,
— দেখ, তোমরা অহেতুক এই আলোচনা করছ। এ আলোচনার কী শেষ হবে কখনও? যুগে যুগে এই আলোচনা চলতেই থাকবে আর আমরা এভাবে ভোলাদার কেবিনে বসে চায়ের কাপে তুফান তুললেও উত্তম ঝড়টা থামানো যাবে না।
-- বাব্বা। তুই তো দেখছি ছুপা রুস্তম। ভোম্বল আর আমি একই বয়সি। তাই ওর সঙ্গে আমার তুইতোকারির সম্পর্ক।
সে আরও বলে,
— সিধু তো ঠিকই বলেছে। আমাদের আলোচনাতে এবার তো দাঁড়ি টানতেই হয়। সকলেরই তো কাজ রয়েছে।
-- ঠিক, ভোম্বল কারেক্ট কথা বলেছে। এবার উঠতে হয়।
এই বলে বাজারের থলিটা হাতে নিয়ে পল্টু উঠে পড়ে একটা সিগারেট কিনতে ভোলাদার দিকে এগিয়ে যায়।
-- কী রে, পল্টু, চললি?
প্রশ্ন করি।
— হ্যাঁ রে। আজকে আবার ফুল কিনতে হবে। বেস্পতিবার।
ভাবলাম আসরটা এবার গুটিয়ে আনা দরকার। তাই আলোচনার রেশ টেনে বললাম,
— দ্যাখো, সবার কথাই শোনা গেল। অযৌক্তিক কথা কেউ বলোনি। তবে আমি বলি কী, যে, যে সময় উত্তমকুমার বাংলা সিনেমায় এসেছে আর যখন অকালমৃত্যু এসে তাঁর কর্ম্মধারায় আঘাত করেছে, সেই সময়ের মধ্যে উত্তমকুমার বাংলার মানুষের মনের মধ্যে যে বিরাট একটা সাম্রাজ্য গড়ে দিয়ে গেছে, বাংলার মানুষের মনে সেটা আজও অক্ষুন্ন রয়েছে। মনে গেঁথে রয়েছে। বাংলা সিনেমা জগৎকে একা উত্তমকুমার অনেকটাই টেনে তুলে দিয়েছিল যদিও তার জীবনে সেই প্রভাব তেমন করে পড়েনি। তাই আজকে তাঁর জন্মদিনে তার কাজকে সম্মান জানিয়ে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
-- বাহ্‌ তুই তো বেশ দারুণভাবে আলোচনাটা শেষ করলি সিধু। এই বলে বটু বেঞ্চের ফাঁক দিয়ে তার লম্বা ঠ্যাং দু’টো বাইরে বের করে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ভোলাদার টেবিলের দিকে এগিয়ে আজকের দামটা মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
-- বেশ বলেছ ভায়া। উত্তমকুমার উত্তমকুমারই। কেউ তাকে ছুঁতে পারেনি আর এতদিন হয়ে গেল, কেউ পারবেও না।
এই বলে বটুর কাছ থেকে পয়সা নিতে নিতে কথাগুলো বলে ভোলাদা নন্টেকে ডাক দেয়।
— ঠিক বলেছ, ভোলাদা, গুরু হল আনপ্যারালাল।
এই বলে হাঁদা উঠে পড়ে। নন্টে এসে জায়গাটা পরিষ্কার করতে শুরু করে। আমরাও দোকানের বাইরে বেরিয়ে আসি। বাইরে বেরিয়ে হাঁদাকে পাশে নিয়ে বলি,
— আজকে নতুন করে তোর গুরুকে স্মরণ করা গেল রে হাঁদা। এভাবেই উত্তমকুমার মানুষের মনে চিরটাকাল বেঁচে থাকবে, বুঝলি।
— রাইট।
তৃপ্তির আস্বাদ নিয়ে সকলে সকলের থেকে আলাদা হয়ে একে একে যে যার কাজে ব্যস্ত হতে ভোলাদার কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ে। দোকানটা খালি হয়ে যায়। ভোলাদা টেবিল থেকে অগোছালো কাগজের পাতাগুলো নন্টেকে নিয়ে আসতে বলে সেগুলোকে আবার গুছিয়ে নিয়ে চশমাটা নাকের ওপর নামিয়ে ভোলাদা কাগজটা পড়তে থাকে।
সেদিনের মতো ভোলা কেবিনের আড্ডাটা ওখানেই শেষ হয়।
 
সমাপ্ত

 

2 comments:

মোহিনীমায়া


Popular Top 10 (Last 7 days)