বাতায়ন/ছোটগল্প/১ম
বর্ষ/২৫তম সংখ্যা/১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
ছোটগল্প
মহাদেব প্রামাণিক
নিঃশব্দতা পেলো শব্দ
দেখো অনু তুমি নাচ
ছেড়ে দিয়ো, জানোই তো আমাদের পরিবার কত্ত রক্ষণশীল, বাড়ির বউ ফাংশনে নাচবে এটা
কেউই মেনে নিতে পারবে না, আমিও না। বিয়ের প্রথম দিন রাতে অলকের মুখে এমন কথা শুনে
অবাক হয়েছিল অনু। বিগত দু’দিনের নিয়মকানুন আর খাওয়াদাওয়া সময় মতো না হওয়ায়
বড় ক্লান্ত ছিল সে, অনুর প্রথম ভালবাসা নাচ, ভরতনাট্যম নাচে সে বেশ পারদর্শী। ও
হ্যাঁ, অলক প্রথম কলেজের একটা প্রোগ্রামে এই নাচ দেখেই নাকি মুগ্ধ হয়েছিল। তবে আজ
কেন এমন বলছে! পুরুষের প্রশংসা কিঞ্চিৎ নারীদের মন রাখার জন্য ব্যবহার করে, কাছে
পাওয়ার আগে যার নাকের নোলক, কানের দুল, চুলের খোঁপা সব জরিপ করে বলে দিত বেশ বেশ,
দারুণ। আজ তবে কেন এমন বদলে যাওয়া।
অনু তেমন মেয়ে নয় যে
মুখ লুকিয়ে কেঁদে বেড়াবে সে যথেষ্ট ডানপিটে, ছাত্র রাজনীতি করেছে কিন্তু বিয়ের
পর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এত কিছু নিয়মের ফিরিস্তি আর বেঁধে দেওয়া হয়েছে আঁচলে
একগোছা চাবি এই সেই সংসারের জাঁতাকল। নূপুর জোড়া যত্নে তুলে দিয়েছে আলমারিতে।
সংসারে দিয়েছে মন, সময় তো ছুটছে, অনু বাধ্য মেয়ের মতো সব মেনে নিয়ে নাচ
ছেড়েছে। তবে গান শুনলে ওর পা তো স্থির থাকে না, তবুও সংযত থেকে এমন কোনো কাজ
করেনি যাতে তার প্রেমিক, এখন স্বামীর কোনো অপমান হোক। বাড়িতে গাদা লোক আইবুড়ো
ননদ, বিধবা পিসি তাদের হাজার রকম ফরমায়েশ। আধুনিক শিক্ষিত মেয়েটা সব মেনে
নিয়েছে। এইভাবে কত বসন্ত কেটে গেছে। এখন অনুর সোনা-মা হাঁটতে শিখেছে, আর মুখে
মিষ্টি মিষ্টি বুলি।
যেন এই দিনেরই অপেক্ষা
করছিল অনু। আলমারি থেকে নূপুরগুলো নামিয়ে ধুলো ঝেড়ে মায়ের হাত থেকে মেয়ের হাতে
নূপুর তুলে দেবে ফুটফুটে হাতে, এ দৃশ্য দেখবার মতো। অনুর চোখে জল এলো, যারা এতদিন
এত বাধা দিয়ে এসেছে তারাও বাধা দিল না, সোনা-মা নাচবে এতে কারুর আপত্তি থাকতেই
পারে না। এই যে এতদিন ধরে নিঃশব্দে পড়ে ছিল এক কোনায়, সেই আবার সুর তুলবে, শব্দ
তুলবে। এ শুধু নূপুরের নিঃশব্দ থাকা তেমন নয়, এ অনুর সব ইচ্ছা, সব স্বপ্নের নিঃশব্দ
থাকা যা আজ আবার নতুন করে শব্দ পাচ্ছে।
অনু এখন সপ্তাহে নাচের
ক্লাস করায় আর সাথে সোনা-মাকে শেখায়। সেদিন ক্লাস শেষে একে একে সব ছাত্রী বাড়ি
যাচ্ছে, সোনা-মা তখনও ছুটি পায়নি, অনু একটা স্টেপ দেখাচ্ছে আর অলক বাড়িতে ঢুকল।
- তোমার নাচে আমি
মুগ্ধ।
- অনু অভিমানের সুরে
বলল, তাহলে আমার নাচের ওপর এত শাসন কেন?
- অনু, মানছি পরিবারের মানসম্মানের
দোহাই দিয়ে তোমায় বারণ করেছি নাচ ছেড়ে দিতে বলেছি। এই যে কিছু বছরের নিস্তব্ধতা
তার পর যে শব্দ তাতে একটা আলাদা আনন্দ তাই নয় কি, দেখো সোনা-মা কেমন শব্দ তুলেই
যাচ্ছে... অনু মাঝরাতের দেখা স্বপ্ন ভাঙার শব্দ আমরা পাই না, তোমার স্বপ্ন যে ভেঙে
যায়নি তারই শব্দ সোনা-মায়ের পা থেকে আসছে।
এমন যুক্তি আর যত্নে
নারী তো গলে যাবেই, অনু এক গাল চোখের জল নিয়ে অলকের বুকে মুখ লুকাল। সোনা-মা মাঝে
একবার নাচ থামিয়ে আবার নাচতে শুরু করল। সারা ঘরময় নূপুরের আওয়াজ। এতদিনের
নীরবতার আওয়াজ।
সমাপ্ত
Nice
ReplyDelete